Get Even More Visitors To Your Blog, Upgrade To A Business Listing >>

মাশরাফি ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’

গলাটা যেন একটু ধরে আসছিল। তবু প্রশ্নগুলোতে চাবুকের ধার। চেহারায় অভিমানের কালো মেঘ। যে প্রশ্নটি মাশরাফি করেননি, মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছিল সেটিও—দেশের হয়ে ১৮ বছর ক্রিকেট খেলে এই কি তবে আমার প্রাপ্তি?
সিলেটে বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে ফুরফুরে মেজাজে মাশরাফি। ছবি: শামসুল হক


প্রতিটি বাক্য বলে একটু করে থামলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। যেন নিজেকে সামলে নিয়ে পরের কথাটা গুছিয়ে নিচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে পাল্টা এল অন্তত চারটি প্রশ্ন। মাশরাফি উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেননি কোনোটিরই।
‘আমি কি চোর?’
‘আমার সমালোচনা আপনারা করবেন, সাপোর্টাররা করবে, লজ্জা পেতে হবে কেন? ’
‘আমি কি বাংলাদেশের হয়ে খেলছি নাকি অন্য দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলছি, যে আমার লজ্জা পেতে হবে!’
‘আমি কি অন্য দেশের হয়ে খেলছি, নাকি চুরি করছি, চামারি করছি?’
গলাটা যেন একটু ধরে আসছিল। তবু প্রশ্নগুলোতে চাবুকের ধার। চেহারায় অভিমানের কালো মেঘ। যে প্রশ্নটি মাশরাফি করেননি, মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছিল সেটিও—দেশের হয়ে ১৮ বছর ক্রিকেট খেলে এই কি তবে আমার প্রাপ্তি?
মাশরাফি, আপনি চোর নন। আপনি চোর হতে যাবেনই বা কেন! দেড় যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আপনি যা দিয়েছেন, তার সবই হয়তো চোখে দেখা যায়নি বা আজও দেখা যায় না। কিন্তু এই ১৮ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির প্রতিটি গাঁথুনিতে আপনার হাতের ছোঁয়া লেগে থাকার কথা দেশের ক্রিকেটকে কাছ থেকে দেখা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ভবিষ্যতে যদি কেউ তা করেও, বুঝতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসটাই তার কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপিত নয়।
আপনি ছিলেন নড়াইলের ডানপিটে ছেলে। নানার বাড়িতে বড় হওয়া সবার অতি আদরের কৌশিক। আপনি গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙেছেন। সাঁতরে চিত্রা নদী পার হয়েছেন। সেই দুরন্ত কৈশোরে আপনার দু-একটি চুরির ঘটনা আমরা জানি। আপনি বন্ধুদের নিয়ে একবার ১১ কাঁদি কলা চুরি করেছিলেন। তুলসী ঠাকুরের বাগানবাড়ি থেকে লিচু চুরি করেছেন। এমন চুরি গ্রামবাংলার প্রতিটি কিশোর করে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে আপনি যত বড় হয়েছেন, আপনার চুরির কথা রূপকথার গল্প হয়েছে। নড়াইলের কিশোর-তরুণদের কাছে সেই দুরন্ত কৌশিকই পরে হয়েছে রোল মডেল। তারা আপনার লিচু চুরি, কলা চুরি মনে রাখেনি। মনে রেখেছে ছোট্ট শহরে দাপিয়ে বেড়ানো কৌশিককে। আপনার দুরন্তপনায় তারা খুঁজে পেয়েছে এস এম সুলতানের শিল্প কর্মের শক্তি। সে জন্যই আপনি আজ তাদের নেতা।
হ্যাঁ, আপনি বড় হয়েও ‘চুরি’ করেছেন। এই চুরি বলতে সত্য গোপন। আপনার দলের কোনো খেলোয়াড় খারাপ খেলেছে, দলের প্রয়োজনে সর্বস্ব দেয়নি; তবু আপনি তার ঢাল হয়েছেন। তাকে ড্রেসিংরুমে বকে এলেও আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন, কই না তো! কারও একার জন্য তো হারিনি। কেউ কি ইচ্ছে করে খারাপ খেলে! আমরা সবাই মিলে ভালো খেলতে পারিনি, তাই হেরেছি। আপনি দলের অনেকের ব্যক্তিগত বিপদে দৌড়ে গেছেন। থানা-পুলিশ করেছেন। তাদের পরিবারের সহায় হয়েছেন। সংকটে পড়ে যাওয়া কারও ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে হয়তো নির্দোষ মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। এসবও এক রকম চুরি, কিন্তু তা বিপন্নকে উদ্ধার করতে। কারও ভান্ডার শূন্য করতে নয়। আপনার সেই সতীর্থদের অনেকেরই হয়তো ওসব আর মনে নেই।
সিলেটের সংবাদ সম্মেলনে আপনি আজ আরেকটি কথা বলেছেন, যেটি হয়তো বাংলাদেশের বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। এত জায়গায় এত চুরিচামারি হচ্ছে। তাদের কোনো লজ্জা নেই। খারাপ খেলার জন্য তাহলে আপনাকে লজ্জা পেতে হবে কেন?
আসলেই তো! বলা হয়ে থাকে একজন ক্রিকেটারের ‘ফর্ম’ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু ‘ক্লাস’ স্থায়ী। আপনার সেই ‘ক্লাস’টাই হয়তো আমরা বুঝতে পারিনি মাশরাফি। আমরা ভুলে গেছি দুই হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার নিয়েও আপনি বল হাতে দৌড়ে গেছেন। লোকে বলবে, মাশরাফি তো নিজের জন্যই খেলেছে। তারা যদি বিবেচনায় এই ব্যাপারটি আনেন যে, বাংলাদেশের প্রায় তারকাহীন সেই সময়ের ক্রিকেট থেকে মাশরাফির ‘মাইনাস’ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ দলটাকেই হয়তো অন্ধকারে ডুবিয়ে দিত, তাহলে ভিন্ন ছবি পাবেন। টেস্ট অভিষেকের ২০ বছর পরও বাংলাদেশের যে পেস বোলিং আক্রমণ অনভিজ্ঞতার অপুষ্টিতে আক্রান্ত, আপনিই হয়ে ছিলেন তার একমাত্র প্রোটিন। অন্ধকারের দীপশিখা। আমরা সেই মাশরাফিকে ভুলে আজ তার ফর্মহীনতা নিয়ে মেতেছি।
ফর্ম একজন খেলোয়াড়ের নাই থাকতে পারে আর ফর্ম না থাকলে কোনো খেলোয়াড় জোর করে খেলতেও পারে না। আপনিও জোর করে বাংলাদেশ দলে নেই। যখন আপনার কিছুই দেওয়ার থাকবে না, একজন জাত ক্রিকেটার হিসেবে তখনো আপনি খেলতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার চাওয়া মানেই এই নয় যে আপনাকে দলে নিতে হবে। সেই বাস্তবতা বুঝেই আপনি বিসিবির চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নির্বাচকদের উন্মুক্ত চিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আর বোর্ড সভাপতি তো বলেই দিয়েছেন, জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর আপনি আর অধিনায়ক নন। এরপর আমরা আর কি চাই? এখন বোধ হয় আপনাকে কড়া গলায় এটিও বলে দিতে হবে যে, ‘আমি মাশরাফি বলছি। খবরদার আমাকে আপনারা দলে নেবেন না।’
প্রিয় মাশরাফি, রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ কবিতাটি আপনিও পড়ে থাকবেন। একজন দেশপ্রেমিকের করুণ পরিণতির সে বর্ণনা আজ আপনার জীবনে কিছুটা হলেও সত্যি। ব্রাউনিংয়ের‘প্যাট্রিয়ট’—এর মতো আপনিও একদিন ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত পথ দিয়ে হেঁটেছেন। যশ-খ্যাতির পাগল করা সৌরভ আপনাকে বিমোহিত করেছে। আপনাকে অভিবাদন জানাতে এ দেশের ক্রিকেটে বেজেছে ঘণ্টাধ্বনি। কিন্তু আজ সেই ‘প্যাট্রিয়টে’র মতোই আপনার দু হাত অদৃশ্য পিছ মোড়ায় বাধা। তার কপালে বেয়ে আসা রক্ত আপনার বেলায় ঝরছে হৃদয় থেকে। পাথর খণ্ডের মতোই নির্দয় সব প্রশ্ন ছুটে যাচ্ছে আপনার দিকে। আপনার কান্না কেউ দেখতে পায় না।
পার্থক্য শুধু একটি। ব্রাউনিংয়ের দেশপ্রেমিক পেয়েছিলেন তাঁর কৃতকর্মের ফল। আর আপনি শাস্তি পাচ্ছেন একজন খেলোয়াড় হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদাটুকু চেয়ে। দুঃখিত মাশরাফি। আমাদের বোধ হয় আপনাকে সেটি দেওয়ারও সামর্থ্য নেই।



This post first appeared on NewsInside - Notícias E Tutoriais Da Cena Homebrew Handheld E Console, please read the originial post: here

Share the post

মাশরাফি ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’

×

Subscribe to Newsinside - Notícias E Tutoriais Da Cena Homebrew Handheld E Console

Get updates delivered right to your inbox!

Thank you for your subscription

×