Get Even More Visitors To Your Blog, Upgrade To A Business Listing >>

ওরা, আমরা এবং মার্কসবাদ


আমাকে সচরাচর দু’ধরনের লোক ফোন করে: প্রথমত টেলিকলাররা, যারা আমাকে নিঃশর্ত লোন দিয়ে ধোনির চেয়েও ধনী বানাতে বদ্ধপরিকর; আর দ্বিতীয়ত. ওলা-উবার ড্রাইভাররা, “ওদিকে যাবো না” বলে রাইড ক্যান্সেল করতে। আমার সন্দেহ ওই টেলিকলারদের থেকে লোন নিয়েই এই ড্রাইভারদের এত পয়সা যে টাইমপাস করতে ট্যাক্সি চালায়, যার খুশি তার রাইড ক্যান্সেল করে দেয়।
তো সেই আমার কাছেই সেদিন সক্কাল-সক্কাল ফোনের বন্যা। একের পর এক বন্ধু। সকলের গলা গম্ভীর, কারুর হাতেই সময় নেই। প্রায় সাঙ্কেতিক বাক্যে কথা।
প্রথমেই শোভনের ফোন। ওর সঙ্গে শেষ দেখা তাম্র যুগে, চাকা আবিষ্কারের মাসখানেক আগে। বিয়েতে নেমন্তন্ন করে নি। ওর যে ছেলে আছে সেটাই আমার কাছে নিউজ।
শোভন বললঃ “হ্যালো...শোন...আমার ছেলের... ৯৮.৫ রে। খুব চিন্তায় আছি।“
আজকাল বাবা-মায়েদের সবেতেই বাড়াবাড়ি। ৯৮.৫ কোন জ্বরই না। স্কুলে পড়েছিলাম মানবশরীরের গড় উষ্ণতা ৯৮.৬ ডিগ্রী। সেটাই ঝেড়ে দিলামঃ ”৯৮.৫, এতে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? ৯৮.৬ তো নর্মাল। এ তো তার চেয়েও কম।“
“জানি,” শোভন যেন একটু চটেই গেল। “জানি আমার ছেলের গড়পরতা ৯৮.৬ এর চেয়ে কম। সেই জন্যই চিন্তা। যাই হোক, অনেককে ফোন করতে হবে। আজ রাখছি।“
একটু বাদেই জয়ন্তর ফোন। বিয়েতে ডেকেছিল, মেয়ের অন্নপ্রাশনেও খাইয়েছিল। মোলায়েম গলায় বল্লামঃ “হ্যালো, ক্যামন আছিস? মেয়ের খবর কি?”
আমাদের হাসিখুশি জয়ন্ত ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে গলাটা কমল মিত্রর মত করে বললঃ “সেই জন্যই তোকে ফোন করা। মেয়ের খবর মোটামুটি রে, ৯৯.২। মামনি তো বিছানা নিয়েছে।”
আমি ভাবলাম শহরে নিশ্চয়ই নতুন flu এসেছে। আজকাল কাগজ কিনি না, কারন ফিকশন লেখে; টিভি দেখি না, কারন IQ কমে আর BP বেড়ে যায়। ফলে জানতেও পারি নি কি হচ্ছে।
বল্লামঃ “গা ব্যথা-ট্যাথা নেই তো?”
“না না, আমরা গায়ে হাত তোলায় বিশ্বাস করি না। ব্যথা মনে। যাই হোক, সবাইকে ফোন করতে হবে। এখন রাখি।“
সবাইকে বলতে হবে কেন বুঝলাম না। মেয়ের জ্বর তো আর অস্কার পুরস্কার না যে জনে-জনে জানাতে হবে।
ব্যাপারটা খোলসা হল যখন বিশু ফোন করে জানালো ওর ছেলের ৯৭.৬। বুঝলাম ৯৮.৫, ৯৯.২, ৯৭.৬ এগুলো জ্বরের টেম্পারেচার নয়, ওদের মার্কসের পারসেন্টেজ!
দোষ আমারও নয়। আমি মার্কামারা মফস্বলের ছেলে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের গন্ধ গা দিয়ে এখনো ভুরভুর করে বেরোয়। "All the perfumes of Arabia..." দিয়েও যাবার নয়। আমরা অবশ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বলতাম না, বলতাম মদ্য-শিক্ষা পর্ষদ। তার ওপর ছিলাম ব্যাকবেঞ্চার। যেখানে শিক্ষা সিলেবাসের ক্ষুদ্র পরিসর ছাপিয়ে শিক্ষকদের মুদ্রাদোষ, পালিয়ে বিয়ে করার সামাজিক প্রয়োজনীয়তা, বান্ধবীহীনতা আশীর্বাদ না অভিশাপ, শ্বশুরের পয়সায় জীবনযাপনের নৈতিকতা ইত্যাদি গুরুগম্ভীর বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতো। শুধু সিলেবাস কাভার করে নাম্বার পাওয়াকে আমরা কাপুরুষতা মনে করতাম। নাম্বারের পেছনে আমরা কখনো ছুটি নি। আরে আমরা তো আর কম্যুনিস্ট নই যে মার্কসের পেছনে ছুটবো! অন্নদাশঙ্করের ছড়া মনে নেই? “যেখানে যা কিছু ঘটে অনিষ্টি/সকলের মূলে কমিউনিষ্টি।“

মার্কস আমরা মার্কশিটে নয়, শরীরে বহন করেছি। স্যারেদের বেতের মার্কস এখনো পিঠে দু’একটা রয়ে গেছে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলি ‘অরগ্যানিক ট্যাটু’। বেঞ্চে বসে-বসে পেছনে মার্কস পড়ে গেছিল। ওটাই ছিল আমাদের বেঞ্চমার্ক। আজকালকার ছেলেমেয়েরা আর তাদের অভিভাবকরা হচ্ছে আদ্যন্ত মার্কসবাদী। আমরা কিন্তু মার্কশিটের ক্ষুদে বক্সে নাম্বার ভরার কথা ভাবি নি। তখন থেকেই আমাদের চিন্তা ছিল যাকে আজকাল বলে আউট-অফ-দ্য-বক্স। আমাদের মেজাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বেদুইন, বইয়ের থেকে মুছে দিতাম বেবাক ডারউইন…”
তো আমরা তো ছিলাম মদ্য-শিক্ষা, মানে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ছাত্র। CBSE খায়, না মাথায় দেয়, জানতাম না। শিবু, যে এখন নৌকো চালায় আর তরমুজ চাষ করে, বিজ্ঞের মত বলল “সি বি আই-এর ছেলেমেয়েরা ওইসব স্কুলে পড়ে, ওদের সাথে পাঙ্গা না নেওয়াই ভালো।“ জগা গরমের ছুটিতে হাওড়ার জগাছা গেছিল, ফিরেই জানালো আরেক ধরনের বোর্ড হয়, যার নাম ICSE। শিবু, যে এখন নৌকো চালায় আর তরমুজ বেচে, বলল “পুলিশের আই সি হয় শুনেছি, হয়তো ওদের বাচ্চাদের জন্য আলাদা বোর্ড।“ জগা বলল অন্য ঘরের বাচ্চারাও যায়। শিবু বলল “তুই বেশি জানিস?” এই নিয়ে দু’জনের ধুন্ধুমার বেঁধে গেল।
দু’বছর পর কলকাতা এক মাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে প্রথম CBSE আর ICSE ছাত্র-ছাত্রী দেখলাম। সত্যি বলতে আলিপুরে সিংহ দেখেও এত মোহিত হই নি। প্রহ্লাদ যে দৃষ্টিতে বিষ্ণুকে, মীরা যে দৃষ্টিতে কৃষ্ণকে, আর ছিঁচকে চোর যে দৃষ্টিতে বীরাপ্পনকে দেখে, আমিও সেই ভক্তি-মেশানো মুগ্ধতা নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বঙ্কিমি ভাষায় “আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।“
আমাদের স্কুলেও ইউনিফর্ম ছিল, আমরা অবশ্য বলতাম “ড্রেস”। থাকলেই যে পরতে হবে মাথার দিব্যি ছিল না। কোমরে কাঁঠালপাতা জড়িয়ে গেলেও চলত, যদিও ছাগলের ভয়ে সেটা সত্যিকারের অপশন ছিল না। বড়জোর কোনো স্যার সস্নেহে কানটা মুলে দিয়ে বলতেন “গাড়ল, আইজ ড্রেস পরশ নাই ক্যান?” বুধবারে ইউনিফর্ম পরতে হতো না, আমরা বলতাম “আজ আনড্রেস”। CBSE/ICSE ছাত্রদের পায়ে পালিশ করা শু; আর আমরা পরতাম মোটা সোলের হাওয়াই, যেটা হাতে গলিয়ে টিফিন পিরিয়ডে ডেস্কে পিং-পং খেলা হতো। ওদের গলায় মা কালির লকলকে জিহ্বার মত টাই, ধবধবে শার্ট, ইস্ত্রি করা প্যান্ট। মুখ ওটিতে-ঢোকার-আগে সার্জনের মত গম্ভীর। দেখেই মনে হয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছে। হয়তো UN হেডকোয়ার্টারস বা হোয়াইট হাউস। হয়তো সেসময়কার কুয়েত যুদ্ধ নিয়ে জরুরি মিটিং আছে।
ওদের নামগুলোও তেমনি। সিদ্ধার্থ, অরুণোদয়, শ্লোক… শুনলেই শ্রদ্ধা হয়। আর আমরা? শিবু, দেবু, বাপ্পা, জগদীশ। আমরা আবার ছড়াও কাটতাম "জগদীশ, কাঁচাকলা সেদ্ধ দিস, তুই না খাইলে বাপরে দিস..." মুরোদ ছিল অরুণোদয় নিয়ে এরকম ছড়া লেখার? অন্ত্যমিলই পেতাম না! ওদের ইস্ত্রি করা শার্ট, বুক পকেটের ওপর স্কুলের ইনসিগনিয়া। আমাদের শার্টের সবকটা বোতামই থাকতো না। শেষমুহুর্তে মা চুড়ির থেকে একটা সেফটিপিন খুলে লাগিয়ে দিত। আমাদের বেশিরভাগের আবার শার্টের কলার চেবানোর অভ্যেস ছিল। কলারের প্রান্তটা ছিবড়ে হয়ে ঝুলতো। গরমে আবার একটু নোনতা-নোনতা লাগতো। অনেক সময় সেলাই ছিঁড়ে ভেতরের বক্রম পর্যন্ত বেরিয়ে আসত। এর নিউট্রিশনাল ভ্যালু কি ছিল জানি না; এতে কনসেনট্রেশন ক্ষমতা বাড়ে এমন বৈজ্ঞানিক প্রমাণও হয়তো নেই। কিন্তু স্কুলজীবনের কঠিন লড়াইগুলো আমরা লড়েছি দাঁতে দাঁত চেপে, মাঝখানে শার্টের কলার ফেলে।
স্কুলে মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে খাদ্যাকর্ষণ বেশি অনুভব করতাম। সেখানেও আমরা-ওরা। কলকাতায় দেখলাম ওরা টিফিনের জন্য স্যান্ডুইচ নিয়ে যায়। আমি মফঃস্বলের ছেলে। আমার ধারনা ছিল স্যানডুইচ খেতে পাসপোর্ট লাগে। আমাদের পাসপোর্ট ছিল না, র্যাশন কার্ড ছিল। আমরা টিফিনে খেতাম বুনোকুল, কামরাঙ্গা, মুড়ি-বাদাম। কখনো ভেতরে কলা জড়িয়ে বাসি রুটি। বিশু একদিন বাসিরুটিতে সর মাখিয়ে এনেছিল। আমরা ওর বিষাক্ত বুর্জোয়া সঙ্গ ত্যাগ করবো ধমকি দিয়ে ওর সরমাখা রুটি বাজেয়াপ্ত করেছিলাম।

কলকাতার মাসির এক ছেলে। চোর না হয়েও আমরা মাসতুতো ভাই। তো সেই মাসতুতো দাদা কলেজে পড়ে, আর আমার গাঁইয়া কাণ্ডকারখানা দেখে মজা পায়। ওদের পাশের বাড়ির একটি মেয়ে রোজ স্কুলে যায়, আমি জানলা দিয়ে রোজ দেখি। একদিন শার্টে নেমপ্লেটের মত একটা জিনিস দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। দাদাকে বিজ্ঞের মত বললাম, “মেয়েটার ডিফেক্ট আছে।“ দাদা চমকে বলল “কে বলল তোকে?” বললাম “বুকের ব্যাজে লেখা আছে।“ দাদা একটু থমকে-টমকে গিয়ে তারপর চাঁটি মেরে বলল “’ডিফেক্ট’ নয়, ‘প্রিফেক্ট’ লেখা ছিল হাঁদারাম। ও পড়াশুনায় খুব ভালো।“ এও বলল ওখানে স্কুলে টিচাররা ছাত্র-ছাত্রীদের গায়ে হাত দেয় না। আমি অবাক হয়ে বললাম “তার মানে পড়াশুনা হয় না?” না প্যাঁদালে যে পড়াশুনা সম্ভব নয়, এ বিষয়ে আমি ও বন্ধুরা নিঃসন্দেহ ছিলাম। স্টকহোম সিনড্রোমের এর চেয়ে শক্তিশালী উদাহরন সম্ভব নয়।
আমরা-ওরা ব্যাপারটা আরও প্রকট হল যখন আমাদের মফস্বলেও সাড়া জাগিয়ে একদিন একটি CBSE স্কুল খুলল। ওদের স্কুলে প্রিন্সিপাল, আমাদের স্কুলে ‘হাতে চক-ডাস্টার, বোকা হেডমাস্টার’। আমরা ভেবেই আকুল “প্রিন্সিপাল” কেন বলে। বোদ্ধা শিবু, যে এখন নৌকো চালায় আর তরমুজ বেচে, ব্যাখ্যা দিলঃ “ছাত্র-ছাত্রীগুলো দেখতে প্রিন্স আর প্রিন্সেস এর মত তাই।“ জগা বলল “এটাও বল, এত টাইটেল থাকতে শেষে ‘পাল’ কেন?” বিড়ি সবে শিবুকে ধরেছে। তারই একটার মুখাগ্নি করে বলল, “উনি ওদের পালন করেন, তাই পাল।“ ওরা স্কুলে ঢুকত সৈন্যের মত, আমরা ঢুকতাম ঢিল-পড়া-চাকের বোলতার মত।
অবশেষে একদিন ধ্বসে পড়লো ওরা-আমরার এই বার্লিন প্রাচীর। প্রথমে ওদের একজনের সাথে বন্ধুত্ব হোল। সে হল আমাদের ‘রিং মাস্টার’, অর্থাৎ সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে রিং বানাতে শেখাল। বুঝলাম জাতভাই। ধীরে ধীরে জুটলো আরও অনেকে। দেখলাম বেশিরভাগই আমাদের মতই ফাঁকিবাজ, বখাটে, উচ্ছন্নগামী। আমাদের যে শুধু হীনমন্যতাই কেটে গেল তা নয়, এদ্দিন ভাই বলে বুকে টেনে নিই নি জন্য আক্ষেপও হল। তারপর আমরাও বড় হলাম, আমাদের অনেকেরই ছেলেপুলে বুট-টাই পরে, টিফিন বাক্সে স্যান্ডুইচ পুরে CBSE/ICSE স্কুলে যায়। বছর শেষে ঝুড়িভর্তি মার্কস নিয়ে ফেরে। পাক্কা মার্কসবাদী সব।

@babumoshoy (আমার নাম 'সংগৃহীত' নয়। শেয়ার করলে নামসহ করবেন প্লিজ)
Pix


This post first appeared on Doosra, please read the originial post: here

Share the post

ওরা, আমরা এবং মার্কসবাদ

×

Subscribe to Doosra

Get updates delivered right to your inbox!

Thank you for your subscription

×