Get Even More Visitors To Your Blog, Upgrade To A Business Listing >>

আমার শহর



                                                                        

প্রথম পর্ব



– " বিয়ের পর থেকে তোর বাবার সাথে কম তো ঘুরলাম না। পুনে, ব্যাঙ্গালোর, রায়পুর, ত্রিচি কত শহরেই তো থেকেছি আমরা। শেষে এই দিল্লী এসে থিতু হলাম। কিন্তু, কলকাতার মত আর কোন জায়গা নেই। যদি বলিস কেন? হয়তো কারণটা ঠিক বলতে পারব না। ভাললাগার কি আর সবসময়ে কারণ থাকে রে।" – এরকম করেই বলতেন কল্যাণী। 


 চুপ করে নবনীতা ও শুনত না। উল্টে বলে উঠত, " রাখো তো তোমার সবসময় কলকাতা কলকাতা। আর এতই যদি প্রিয়, তবে আর কোনোদিন যাও নি কেন? আমাকেও তো নিয়ে যেতে পারতে।"


  কল্যাণী জবাব দিতেন না। উপস্থিত থাকলে বরং মা মেয়ের কথার মাঝখানে অশোক বলে উঠতেন, " যেতে চাইলেই কি আর সব সময় যাওয়া যায় রে মা? যায় না।"  অশোক আর কল্যানীর হয়ত চোখের ইশারায় সহমর্মিতা আর যন্ত্রণার আদানপ্রদান হত। তখন ওসব দেখার বা বোঝার মন নবনীতার কোথায়?


  ক্যান্সার ধরা পড়ার তিন মাসের মধ্যে যখন কল্যাণী চলে গেলেন, নবনীতার মনে হয়েছিল অনেক কিছু বাকি থেকে গেল। কত কথা বলার ছিল মা কে। কত গল্প শোনার ছিল। কল্যাণী কোনোকিছুর সুযোগ দিলেন না।


  তাও ভালো নবনীতার বিয়ে দেখে গেছিলেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর একদিকে ভালোই হয়েছিল। ওই বাড়িতে নবনীতা থাকতে পারত না। বাবা কে দেখতে গেলেই কেমন বাড়িটা ফাঁকা লাগে। মা এর এত সাধের বাড়ি আর মা নেই। মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হয় নবনীতার।


  অভি অফিসের কাজে বরাবরের মত ব্যস্ত। নবনীতা কিন্তু কিছুতেই নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারছিল না। তাই ফ্রিল্যান্সিং ফটোগ্রাফি থেকে কিছুদিনের ব্রেক নিয়েছিল  ও। যদি একটু মনটা শান্ত হয়।

 

  কিছুদিন রান্না করার চেষ্টা করেছিল নবনীতা। মায়ের হাতের প্রিয় রান্নাগুলো। মা কে কোনোদিন জিজ্ঞেস ও করা হইনি, মা এর পাশে দাঁড়িয়ে শেখা ও হয়নি।  স্বাদ মনে করে নিজেই মুড়িঘন্ট ট্রাই করল একদিন। আর একদিন মায়ের স্পেশাল গার্লিক চিকেন। কোনোটাই খারাপ হয়নি। কিন্তু মায়ের হাতের সেই স্বাদ আসেনি। 


এর মধ্যেই অভির ট্রান্সফার হওয়ার সম্ভাবনা জানিয়েছিল অফিস থেকে। একদিন  অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে অভি বলল, " মনে হচ্ছে এত খাটনির ফল পাচ্ছি। সিনিয়র পোস্টের দায়িত্ব দিচ্ছে কিন্তু দিল্লী থেকে হবে না। "


চায়ের জল চাপাতে চাপাতে নবনীতা জিজ্ঞাসা  করে, "কোথায়?" একটু বিরক্ত ও লাগে ওর।

  

–"ব্যাঙ্গালোর গিয়ে সাউথের অপারেশন দেখতে বলছিল বাজাজ। তবে এই পোস্টিং খুব বেশি দিনের নয়, খুব বেশি হলে এক বছর। তার কমেও হয়ে যেতে পারে। তখন কোম্পানি অন্য ভাবনা ভাববে।"  হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলে অভি।


– " তো কবে যাচ্ছি আমরা ব্যাঙ্গালোর?" দুজনের চা নিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে নবনীতা।


      –" বেশি সময় নেই। টু উইকস। তবে, ব্যাঙ্গালোরে না। কলকাতা। ওটা সেকেন্ড অপশন ছিল। আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি।" চায়ে চুমুক দিয়ে বলে অভি।


– " কলকাতা!"  এতদিন পর তাহলে এভাবে সেই ছোটবেলার থেকে শোনা কলকাতার সাথে আলাপ হবে। মায়ের শহর। মায়ের বেড়ে ওঠা, বাবার সাথে আলাপ – সবকিছুর পটভূমি কলকাতা। যেখানে মা আর কোনোদিন ফিরে যায়নি। নবনীতা কিন্তু যাবে। 


      –" ওই, কোথায় হারিয়ে গেলে? খুশি তো এবারে? টুরিস্টের মত  সাত দশ দিনে নয়, অনেকদিন ধরে কলকাতা দেখতে পারবে। আন্টির কলকাতাকে খুঁজতে পারবে এখনের শহরের মধ্যে। ডিস্টার্ব করার জন্য আমিও থাকবনা কারন প্রচুর ট্যুর করতে হবে নর্থ বেঙ্গল আর নর্থ ইস্টে। খুশি তো?"


     – " কি করে বুঝলে?"

       – " আরে বিবি, তোমার মনের কথাই যদি না বুঝি তিন বছর তাহলে প্রেম করে আর বিয়ে করেছি কি করতে। এবার কলকাতার প্রিপারেশন শুরু করে দাও।" অভি আজ দারুন মুডে।


      নবনীতা মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল। ওদের দুজনের একসাথে কাটানোর সময় কমে যাবে। অবশ্য বেশি দিনের জন্য নয়। তবে ও নিজের ইচ্ছে মত কলকাতা ঘুরে মা কে খুঁজতে তো পারবে।  


  

দু সপ্তাহের মাথায় কলকাতা এয়ারপোর্টে ফ্লাইট থেকে নামতে নামতেই অভি বলল, " এ তো প্রচন্ড হিউমিড। এপ্রিলেই এরকম হলে মে জুনে তো হালত খারাপ হয়ে যাবে।"


      কথাটা ভুল নয়। কিন্তু, নবনীতা তখন কলকাতাকে প্রথমবার দেখছিল। মায়ের মায়া চশমা পরে। দেখা যাবে কে জেতে কলকাতার প্যাচপ্যাচে গরম আর ওর মায়ের শহরের মধ্যে। 


                                      * * *


      কলকাতা আসার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। প্রথম কিছুদিন হোটেল থেকে তারপর সল্টলেকে বাড়িটাও বেশ পাওয়া গেছে ভালো। নবনীতার যদিও ইচ্ছে ছিল উত্তর কলকাতায় থাকার।কিন্তু, এই বাড়িটা সবদিক দিয়েই ওদের দুজনের পছন্দ হয়ে যাওয়ায় আর ভাবেনি। জিনিসপত্র গোছাতে কয়েকটা দিন সময় লেগেছিল, তারপর নবনীতা আস্তে আস্তে নিজের কাজকর্ম আবার শুরু করে। নতুন কিছু অ্যাসাইনমেন্ট আসার পর ওই ছবি তোলার কাজে এদিক ওদিক বেরোতে শুরু করল ও।  


      একটা ওয়েব পোর্টাল এর জন্য পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে হয়েছিল।  শ্যুট মিটে যাওয়ার পর অনেকটা সময় হাতে থাকায় কি করি, কি করি ভাবতে শুরু করল নবনীতা। যেই জন্য কলকাতায় আসা, এখনো তা শুরুই হয়নি।  মা তো এদিকের কথাও খুব বলত।  হ্যাঁ, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামেই তো বাবা আর মা আসতো। তবে এটা দিয়েই শুরু হোক। এই ভেবে মিউজিয়ামে ঢুকে পড়ল নবনীতা।


      ভাস্কর্যের গ্যালারিতে আনমনা হয়ে মূর্তিগুলো দেখছিল ও। হটাৎ ঘড়ি দেখে খেয়াল হল তিনটে বেজে গেছে। বাড়ি ফিরে ছবিগুলো প্রসেসিং করতে আরো কয়েক ঘন্টা লাগবে। ডেডলাইন কাল হলেও একদিন আগেই কাজ সেরে নেওয়ার অভ্যেস আছে ওর। এই ভেবে বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে কে ডেকে উঠলো– 


– "এই যা, সরে গেলে। আর আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে যাও না, প্লিজ। অনেকটা হয়ে এসেছে।" 


আর্ট কলেজের অনেকেই মাটিতে বসে আঁকছিল। তাদের মধ্যে আলাদা করে খেয়াল না করলেও এখন ওই ছেলেটার কথা শুনে ফিরে তাকালো নবনীতা।


– "এক্সকিউজ মি?" কৈফিয়ৎ চাওয়ার সুরে বলে নবনীতা।

 – "না, মানে, আমি নই,  তোমার ছবিটা আঁকতে শুরু করে দিয়েছিলাম। বেশ কিছুটা হয়ে এসেছে। আর যদি একটুখানি দাড়াও তাহলে মোটামুটি ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেয়া যাবে।" একটু কাচুমাচু মুখেই ছেলেটা বলে। কুড়ি একুশ হবে হয়ত খুব বেশি হলে।।

  

      এদিকে চট করে মাথা গরম হয়ে যায় নবনীতার, " আঁকার আগে পারমিশন নেওয়াটা জরুরি মনে করোনি।দেখি, ছবিটা দাও।"  হাত বাড়ায় ওর দিকে নবনীতা।


      –" আরে, কি করছো কি? ছবি শেষ হওয়ার আগে আমি কখনো কাউকে দেখাই না।" ড্রইং বোর্ড নিজের দিকে আঁকড়ে ধরে ছেলেটা।


      –" আজব তো। একে তো পারমিশন না নিয়ে ছবি আঁকছো, আবার বলছ আমাকে দেখাবে না। দাও বলছি। নাহলে আমি কিন্তু তোমার নামে কমপ্লেন করব।" 


নবনীতার কড়া কথাবার্তা শুনে আর কথা বাড়ায় না ছেলেটা। কাচুমাচু মুখে একটা কাগজ তুলে দেয় নবনীতার হাতে।


       কাগজ দেখে একটু অবাক হয়ে যায় নবনীতা। এতে তো শুধু লাইন ড্রয়িং। বেসিক স্ট্রাকচার ছাড়া কিছুই নেই। একটু প্রশ্নের চোখে তাকায় নবনীতা ।

 

     – " বেসিক আউটলাইন করে নিচ্ছি,  বাকি আমার মাথায় ঢুকে গেছে। পরে আস্তে আস্তে করবো।" জবাবদিহির সুরে বলে ছেলেটা। সাপোর্টের জন্য আশেপাশে বন্ধুদের দিকে তাকায় ও। কিন্তু, কে আর যেচে এই ঝামেলায় জড়াবে।


     – " এটা আমি নিয়ে নিলাম।আর কিছু করতে হবে না।" কাগজটা রোল করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় নবনীতা।


     – "প্লীজ লেট মি এক্সপ্লেন। দশটা মিনিট দাও।" শেষ চেষ্টা করে ছেলেটা ওর ড্রইং উদ্ধার করতে।


– "আমার  এতো সময় নেই বুঝলে। " এই কথা ছুড়ে দিয়ে ছেলেটার বার বার বলা প্লিজ গুলোকে অগ্রাহ্য করে  গটগট করে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে যায় নবনীতা


     বাড়ি ফিরে  ছবিগুলো এডিট এর কাজ শেষ করে অ্যাসাইনমেন্ট মেইল করে দেওয়ার পর একটা স্ট্রং কালো কফি নিয়ে বসল নবনীতা।


      মিউজিয়াম এর কথা ভেবে নিজেরই হাসি পাচ্ছিল। না, বাচ্চা ছেলেটাকে একটু কড়া ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে। যাক,  এই লাইন ড্রইং রেখে ওর নিজের তো কোনো লাভ হবে না, বরং ফেরত দিলে তাও নিজের একখানা পোর্ট্রেট পাওয়ার আশা থাকবে। কিন্তু পাবে কোথায় ওই ছেলেকে। নামটাও তো জানা নেই। তবে, মনে  তো হয় আর্ট কলেজের স্টুডেন্ট। ওই মিউজিয়ামেই ধরতে হবে আবার। কফির খালি কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে ভাবে নবনীতা।




দ্বিতীয় পর্ব



  মিউজিয়াম ঢুকে গ্যালারিতে ছেলেটাকে কোথাও দেখতে পেল না নবনীতা। তবে আগেরদিনের ঝামেলাটা অনেকেই খেয়াল করায় একদিকে সুবিধাই হল। দু-একজন কে জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল যে, ও আজ মিউজিয়াম এ আসেনি। অবশ্য তাতে প্রবলেম হয়নি। ওর এক ক্লাসমেট, মিষ্টি করে একটি মেয়ে, ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিলো।

  প্রথমে একটু থতমত খেলেও তারপরে দেখা করতে রাজি হয়ে গেল ছেলেটা। আর্ট কলেজেই আছে। তাই তখনই দেখা করার প্ল্যান হল।


  মিউজিয়াম এর পুরোনো গেটের সামনে কিছুক্ষন পর প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এলো ছেলেটা। এসেই বলে, "শোনো না, কমপ্লেন টমপ্লেন করো না। ছেড়ে দাও।"


 হাসিমুখে নবনীতা বললো, "ভয় নেই। আমিও একটু ওভাররিয়াক্ট করে ফেলেছিলাম। এই নাও, তোমার ছবির খসড়া।" কাগজটা ফেরতের জন্য বাড়িয়ে ধরে ও।


  –"থ্যাংক ইউ দিদি।" একটু নিশ্চিত হয় ছেলেটা।


  –"খবরদার! দিদি নয়। দিদি তো কলকাতায় একজনই আছেন। আমি নবনীতা।" একটু হালকা মেজাজেই বলল ও।


      –"হ্যাঁ হ্যাঁ, আলাপ টা ঠিক করেই করা যাক বলো। চা খাবে?" 


– "চল। অক্সফোর্ড এ চা বার এ যাওয়া যাক।" অফার করে নবনীতা।


      ওর অফার নস্যাৎ করে দিয়ে কলকাতার তরুণ বলে, "ধুর, তুমি এস আমার সাথে। চায়ের স্বাদ পেতে হলে মাটির ভাঁড়ে খেতে হয় বুঝলে।"


      সদর স্ট্রিট এ দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বেশ মজা ই লাগছিলো নবনীতার। মায়ের বারবার বলা সেই কলকাতার উষ্ণতার ছোঁয়া পাচ্ছিল যেন ও।


      – "আমি অর্ক। অর্কদীপ সেন। আমি কিন্তু পোর্ট্রেট এমনিতে আঁকি না। কিন্তু কাল তুমি যেভাবে আনমনা হয়ে ওই মূর্তি গুলো দেখছিলে, পুরো কম্পজিশনটা একটা ছবি হয়ে গেল মাথায়। আর কিছু না ভেবেই শুরু করে দিয়েছিলাম।" আলাপের সঙ্গে কৈফিয়ৎ ও দেয় অর্ক।


      – "আরে থামো। আমি কিন্তু এমনি এমনি আলাপ করছি না। শর্ত আছে।"  একটু গম্ভীর হয়ে



This post first appeared on Meaningless Crap, please read the originial post: here

Share the post

আমার শহর

×

Subscribe to Meaningless Crap

Get updates delivered right to your inbox!

Thank you for your subscription

×