Get Even More Visitors To Your Blog, Upgrade To A Business Listing >>

করোমন্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার বিভিষিকাময় রাত কাটিয়ে যারা ফিরলেন। কি হয়েছিল সেদিন রাতে?

যারা বেঁচে ফিরলেন। ওপর থেকে সায়ন্তনি ঘোষ, সুজন মন্ডল, অনুভব দাস                                            ছবি সংগৃহীত 



তথ্য সংগ্রহ : সুলেখা দাস

গত চল্লিশ বছরের সবথেকে ভয়াবহ করোমন্ডল এক্সপ্রেস  ট্রেন দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। গত শক্রবার অর্থাৎ ২ জুন ২০২৩ দিনটি ইতিহাসের পাতায় কালা দিবস হিসেবেই গণ্য হবে। বলেশ্বরের করমন্ডল এক্সপ্রেস, যশোবন্তপুর এক্সপ্রেস ও মালগাড়িতে সংঘর্ষে ফলে গত তিনদিনের মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩০০। ৯০০ জনেরও বেশি আহত। তবে যারা ওই বিভিষিকাময় রাতে লাশের ওপর হেটে বেঁচে ফিরলেন তিনদিন কেটে গেলেও তাঁদের মুখে চোখে তখনও কাটেনি আতঙ্ক ও ভয়। চোখ বুজলেই যেন হাতছানি দিচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর রাত, মানসিক ও দৈহিক আঘাত। 


স্থানীয়রা ছুটে এসেছিলেন উদ্ধার করতে। তবে সবকিছুরই দুটি দিক থাকে। একদিকে যেমন কিছু মানুষ দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বগি থেকে তাদের উদ্ধার করেছেন। অন্যদিকে সেই গ্রামেরই কিচ্ছু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বগি চুরি করতেই বেশি ব্যাস্ত ছিলেন বলে দাবি অনেক যাত্রীর। কি হয়েছিল সেদিন রাতে? প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরে আসা যাত্রীরাই বর্ণনা দেন সেই অভিশপ্ত রাতের। 



পিকনিক গার্ডেনের  বাসিন্দা সায়ন্তনি ঘোষ তাঁর এগারো বছরের কন্যাকে নিয়ে  করমন্ডল এক্সপ্রেস এ১ কামরায় যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যেবেলার লোয়ার সিটে বসেছিলেন তিনি। হঠাৎ এক বিকট শব্দ তার সঙ্গে মারাত্মক ঝাঁকুনি অনুভব করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কামরাগুলি লাইনচ্যুত হয়েছে এবং সংঘর্ষের জেরে কাচের বাইরে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেয়েছিলেন।   তিনি বলেছিলেন "সামনের কামরার বাথরুম আমাদের কামরায় ঢুকে পড়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা ছুটে আসে উদ্ধারকাজে হাত লাগাতে কিন্তু তাদের আরও একটি রূপ ফুটে উঠেছিল তার অভিজ্ঞতায়। তিনি বলেছিলেন "সাহায্য করার জন্য ব্যগটি নিয়েছিলেন এক স্থানীয় ব্যক্তি কিন্তু আর ফেরৎ দিলেন না।   সামনের কামরা থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের চুরি করতেও দেখলাম।এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আমি  মেয়েকে নিয়ে ওই দুমড়ানো কামরার মধ্যে থেকে এসে ২কিলোমিটার হেঁটে লাইনের অপরপ্রান্তে পৌঁছানোর পর আরও ভয়ঙ্কর বাস্তবের সঙ্গে  মুখোমুখি হলাম, দেখলাম আস্ত লোহার বগিগুলি কাগজের মত কুঁচকে গিয়েছে। চারিদিকে শুধুই আর্তচিৎকার। এই সব দেখে আমার সন্তান পাতার মতো কাঁপছে।  ও আমাকে একটা কথা বলল যে সবাইতো বেরিয়ে ছিলাম বাড়ি ফিরব বলে, কিন্তু তা তো সবার হলো না। আচ্ছা যদি  ওই কামড়াগুলিতে কোনো শিশু থাকে!  তার আঘাত লাগলে , যে ভাবে বগিগুলো দুমড়ে গেছে তাতে তো তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমি ওর মুখে এই কথা শুনে আরো ভেঙে পড়েছিলাম।" তিনি  চোট পেয়েও সন্তানকে নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা  থেকে তাই বারবার ভগবানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন। 


 দাসপুরের সুজন মণ্ডল খড়গপুর থেকে উঠেছিলেন করমন্ডল এক্সপ্রেস। তিনি  দীনদয়াল কোচে উঠবেন ভেবেছিলেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনস্থির করেন এস ফাইভে উঠবেন সেই ভাবনার জন্য বারবার তার ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তার কথায় "লুপ লাইনে করমন্ডল এক্সপ্রেস ঢোকার কয়েক সেকেন্ড পরই চালক বুঝতে পারেন এবং এমার্জেন্সি ব্রেক কসেন তখন চারিদিক থেকে ধুলোবালিতে ভর্তি হয়ে যায় বিকট শব্দ হতে থাকে তার সঙ্গে আগুনের ফুলকি এবং ট্রেনের ভেতর পাওয়ার কাট হয়ে যায়। পাশের দেখি দরজার পাশে বসে থাকা ৫-৬ জন ছিটকে কোথায় চলে গেল খুঁজে পেলাম না,  ট্রলি ব্যাগ  আটকে যায় দরজায় আর বাথরুমের দরজার একটি অংশ শক্ত করে ধরেছিলাম সেই অবস্থায় ট্রেনটি তখনও যথেষ্ট জোরে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল, ট্রলি ব্যাগটি যদি গেটে  না থাকতো আমিও   স্লিপ করে পড়ে যেতাম এবং চাপা পড়তাম ট্রেনের নিচে। এই ঘটনার কয়েক সেকেন্ড পর ধাতস্থ হলাম এবং তার আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা হয়েছে তবে তার তীব্রতা যে এতটা ভয়ংকর সেটা বুঝতে পারেনি।  এই সময় মোবাইলে ইমারজেন্সি মোড হয়ে গিয়েছিল।  নিচে নেমে এসে লাইট জেলে দেখি ঠিক আছি আমি,  সেখান থেকে লাইভ করার চেষ্টা করি সবাইকে জানানোর জন্য। কিন্তু লাইভটি শুরু করার কয়েক মিনিটের পর এই লাইভটি বন্ধ করে দিয়েছিলাম  কারণ আমি ওই ট্রেনেরই সহযাত্রী ছিলাম আমার সহযাত্রীদের এইরকম অবস্থা দেখুক আমি চাইনি।  ট্রেনের যত সামনের দিকে এগোচ্ছি তত মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে আমার শরীর খারাপ করতে শুরু করেছিল। কারুর হাত কাটা গেছে তো কারুর ধর মুন্ডু আলাদা। কোথাও বা দোলা পাকিয়ে পড়ে রয়েছে দেহ। খুব ঘামতে শুরু করেছিলাম এবং হার্টবিট ফাস্ট হয়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা আমাকে জলের বোতল প্রাথমিক সেবা যত্ন ও সান্তনা দিয়ে বর্তমান অবস্থায় ফিরিয়েছিলেন। আমি সুস্থ আছি বলে আমি আমার ব্যগটা নিয়ে চলে আসব সেটা করা উচিত নয়, আমিও করিনি সেটা, তারপর আমিও  স্থানীয়দের সাথে উদ্ধারের কাজেও হাত লাগিয়েছিলাম। দুর্ঘটনার আধঘন্টার মধ্যে ওডিআরএফ টিম  পৌঁছে গিয়েছিলেন। অনেকেই বলছে শুনছি স্থানীয়রা চুরি করেছে তবে আমার চোখে পড়েনি। উল্টে আমার চোখে স্থানীয়দের মানবিকতা ছবি ফুটে উঠেছে‌।১৮-২০ বছরের দুটি ছেলে হাইওয়ে পর্যন্ত আসার সময় অর্ধেক রাস্তা আমাকে ছেড়ে দিয়ে যায় এই কারণেই স্থানীয়দের কথা আমার অভিজ্ঞতায় বারবার উঠে আসবে। "



অনুভব দাস যিনি একজন জিওলজি ডিপার্টমেন্টের পিএইচডি রিসার্চ স্টুডেন্ট তিনি কটকে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন। ছিলেন করমন্ডল এক্সপ্রেসে । বিকট শব্দে ট্রেন থেমে যাওয়ার পর কোনরকম নিচে নেমে দেখেন এক্সপ্রেসের আরো কয়েকটি কোচ এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে আছে। তার কথায় " আমাদের কোচের কারো সেরকম কিছু হয়নি। আমরা দশ পনেরো জন এগিয়ে গেলাম তখন দেখলাম সামনে পড়ে থাকা কোচ থেকে মানুষ সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করছে। তখনো আমি ভাবছি আমাদের ট্রেনের কিছু হয়নি, যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসে  দুর্ঘটনা ঘটেছে। তখনই আমরা পুলিশ, ইমার্জেন্সি সার্ভিসে ফোন করি। অসুস্থ মানুষদের জল দিলাম, রেলওয়ে বেডসিট ছিড়ে ব্যান্ডেজ বানিয়ে কিছুজনের প্রাথমিক চিকিৎসাও করলাম। তখন দেখতে পেলাম অনেক এম্বুলেন্স আছে কিন্তু আমাদের দিকে না এসে সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। তখন ভাবলাম আমাদের এখানে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তো  ওখানে কেন যাচ্ছে? তখন আমি আরো কয়েকজনকে নিয়ে সামনের দিকে এগোলাম তখন যা দেখলাম করোমন্ডল এক্সপ্রেসের সামনের কোচগুলির অবস্থা আরো ভয়ংকর। করোমন্ডলের ইঞ্জিন তিন থেকে চার তলা বাড়ির সমান উঁচুতে মালগাড়ির উপর উঠে গিয়েছে। রেললাইন উপড়ে গিয়েছিল, ফিসপ্লেট প্রায় ৪০ থেকে ৫০কিলোমিটার দূরে উড়ে গিয়ে পড়েছে, কিছু মৃতদেহও দুর্ঘটনার স্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়েছিল। রেল আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম রিসেন্ট রেনোভেট হয়েছিল এই ট্র্যাকটি এবং কোচগুলি ছিল অত্যাধুনিক এল এইচ বি কোচ, তাও ঘটনার এত ভয়াবহতা তার কারণ তদন্তের পরই জানা যাবে। ছোট ছোট বাচ্চা তার বাবা মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, গোটা পরিবারের লোকজন চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। কারোর হাত, কারোর পা কেটে গিয়েছে, তো কারোর আবার শুধু মাথা দেখা যাচ্ছে।  একটি পনেরো বছরের ছেলেকে দেখলাম তার বাবার হাত কেটে গিয়েছে বলে তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার নিজেরই মাথা ফেটে গিয়েছে। আমি তিন ঘন্টার মত ছিলাম  দুর্ঘটনার স্থলে আমি তখনই প্রায় ৩০০টি মৃতদেহ দেখেছি। বালেশ্বর থেকে কটক, ভুবনেশ্বর ,ভদ্রক অফিস ফেরত লোক উঠে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।"


যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসে ছিলেন ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক শেখ পল্টু। তার গ্রামের আরো দশটি ছেলে তার সঙ্গে বেঁচে ফিরে এসেছে। তিনি জানিয়েছেন "আমাদের বগি এক তালগাছ সমান উঁচুতে উঠে যায় এবং নয়নজুলিতে  গিয়ে পড়ে। নিজেরাই জানালা ভেঙে মৃতদেহের উপর দিয়ে বেরিয়ে আসি। পুলিশ ও উদ্ধার বাহিনীর কারোর সাহায্য পায়নি।"


 বাঁকুড়া জেলার বাসিন্দা বিদ্যুৎ পাল ও সুজন বাউরী, করমন্ডল এক্সপ্রেসে করে ভিন রাজ্যে কাজে যাচ্ছিলেন। তাদের বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন "আমাদের ছেলেদের আঘাত লেগেছে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওআরএস ও দুটো বিস্কুট এবং জলের বোতল দিয়েছিল। রাতে  কথা হয়েছিল তারা এখন ভালো আছে কিন্তু বাড়ির ছেলে বাড়ি এখনো না ফেরায় উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে আমাদের"।


 যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের ৬ নম্বর কামরায় ছিলেন খাদিজা শেখ, তিনি জানিয়েছিলেন "বাস হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক সেরকম অনুভুতি হয়েছিল। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেছিলাম আমাদের ট্রেনের এক থেকে চার নম্বর বগি লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল।"


কলকাতা টালিগঞ্জের একদম্পতি  চিত্তরঞ্জন বাঘা ও তার স্ত্রী পূর্ণিমা রাউত বাঘা তাদের মেয়ের কাছে চেন্নাইতে  যাচ্ছিলেন করমন্ডল এক্সপ্রেসে করে।  তিনি জানিয়েছেন "ওই সময় বিটু কামরায় ছিলাম, তাই আঘাত কিছুটা কম লেগেছে, কথা বলতে পারছি কিন্তু আমার স্ত্রী বিফাইভে ছিলো। 

উনি মাথায় চোট পেয়েছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফিরে আসি কলকাতায় এবং অ্যাপেলো হসপিটালে চিকিৎসাধীন  এখনো কথা বলার মত অবস্থায় নেই।"



This post first appeared on Bong Journalese, please read the originial post: here

Share the post

করোমন্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার বিভিষিকাময় রাত কাটিয়ে যারা ফিরলেন। কি হয়েছিল সেদিন রাতে?

×

Subscribe to Bong Journalese

Get updates delivered right to your inbox!

Thank you for your subscription

×