Get Even More Visitors To Your Blog, Upgrade To A Business Listing >>

পুরুষ-প্রকৃতি এবং জগন্নাথ - অভিজিৎ পাল | প্রবন্ধ ২০২২ | Avijit Pal | Article 2022

পুরুষ-প্রকৃতি এবং জগন্নাথ

- অভিজিৎ পাল


ভারতের ধর্ম-সংস্কৃতির পৌরাণিক দেবতাদের মধ্যে শ্রীক্ষেত্রেশ্বর জগন্নাথ অন্যতম জনপ্রিয় একজন। জগন্নাথ বহুমাত্রিক দেবতা। সর্বভারতীয় সংস্কৃতিতে তিনি সূর্যসম প্রকাশিত। ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতিটি পৃথক পূর্ণ কলসে সেই এক মহাসূর্যের নিজস্ব প্রতিবিম্ব ধরা পড়েছে। আর সেই প্রতিটি পূর্ণ কলসে সেই মহাসূর্যের সমান ও স্বকীয় অস্তিত্ব আজও বজায় রয়েছে। জগন্নাথের ওপরে প্রায় সমস্ত ভারতীয় ধর্ম-সম্প্রদায় সমানভাবে নিজেদের অধিকার দাবি করেছে। এমনকি পরবর্তী সময়ে একাধিক অভারতীয় ধর্ম-সম্প্রদায়ও জগন্নাথের ওপর তাদের দাবি তুলেছেন। এত সবকিছুর মাঝখানে জগন্নাথ হয়ে উঠেছেন সবার আপনজন। বিশেষত পূর্ব-ভারতের ওড়িশা প্রদেশের প্রত্যেক জনতার কাছে তিনি নিজস্বতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

জগন্নাথ অদ্বৈতবাদী বৈদান্তিকের নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম প্রণবতনুধর, যোগীদের পরমহংসতত্ত্ব, বৈষ্ণবের শ্রীপতি নারায়ণ, শৈবের মহাদেব ভৈরব, শাক্তের আদ্যাশক্তি মহামায়া, সৌরের সূর্য-নারায়ণ, গাণপত্যের বিনায়ক গণেশ, বৌদ্ধের গৌতম বুদ্ধ ও জৈনের সিদ্ধান্তমূর্তি মহাবীর, শিখের কলিকলুষহারী গুরুতত্ত্ব। তিনিই আবার শবর পূজিত সাক্ষাৎ নীলমাধব নারায়ণ, তাঁরই একরূপ অনার্যের আরাধ্য লৌকিক দেবতা কিট্টুং। জগন্নাথের ওপর আজও ভারতীয় কোনো সম্প্রদায় নিজেদের দাবি ছেড়ে দিতে নারাজ। ভারতীয় ইসলাম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বহু মানুষ জগন্নাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ওড়িশার জগন্নাথ সংস্কৃতিতে একটি চমৎকার লোকবিশ্বাস রয়েছে, জগন্নাথ তাঁর ভক্তের কাছে তদ্ভাবরঞ্জিত হয়ে ধরা দিতে ভালোবাসেন, তিনি ভক্তের জন্য সবসময় কল্পতরু। তাই জগন্নাথ সংস্কৃতিতে জগন্নাথ মহাপ্রভুকে একই সঙ্গে পিতা ও মাতা বলা হয়। ওড়িশার রঘুরাজপুর উৎকলী ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের জন্য বিখ্যাত। রঘুরাজপুর গ্ৰামের পটশিল্পীদের আঁকা এক রকমের পটচিত্রে দেখা যায়, জগন্নাথ মাতা রূপে জগন্নাথকেই স্তন্যদান করছেন। এখানে ভাবনাটি এমন যে, জগন্নাথ স্বরূপত অদ্বৈত এবং তিনিই লীলাবিলাসের আকাঙ্ক্ষায় বহু হয়েছেন। ওড়িশার জগন্নাথ-ধর্মে, জগন্নাথ ভিন্ন জগৎ সংসারে আর কিছুই নেই। আব্রহ্মকীটপরমাণু সবই জগন্নাথ। এই ভাবনা অনুযায়ী, যা আছে তা-ই জগন্নাথ, এমনকি যা নেই তাও জগন্নাথ। আবার এই বিরাট স্বরূপে জগন্নাথই পুরুষ ও প্রকৃতি হয়েছেন। অবশ্য এর সঙ্গে দ্বৈতবাদী সাংখ্য দর্শনের ভাবধারা মিশে রয়েছে। সংস্কৃত শাস্ত্রের মধ্যে অন্যতম পাণ্ডবগীতায় ঈশ্বরের স্বরূপ ও সর্বব্যাপী সত্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে :

“ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব 
ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব।
ত্বমেব বিদ্যা দ্রবিণং ত্বমেব 
ত্বমেব সর্বং মম দেবদেব।।”১ (পাণ্ডবগীতা, ২৯) 

অর্থাৎ, যিনি পরমপুরুষ, তিনিই পরমাপ্রকৃতি হয়েছেন। যেন অগ্নি আর দাহিকাশক্তি। একটি মানলে অন্যটি মানতে হয়। বেদান্তের অন্তর্ভুক্ত বৃহদারণ্যক উপনিষদে পুরুষ ও প্রকৃতির উৎস সংক্রান্ত একটি চমৎকার আখ্যান রয়েছে। বৃহদারণ্যকে (১/৪) রয়েছে, এই জগৎ-সৃষ্টির আগের মুহূর্তে একমাত্র পরমসত্তা অব্যক্তরূপে বিদ্যমান ছিলেন। এই পরমতত্ত্ব হলেন পরম-আত্মা। পরমতত্ত্বই সবদিকে চেয়ে দেখে একমাত্র নিজের অস্তিত্ব ছাড়া দ্বিতীয় আর কাউকেই দেখতে না পেয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘সোহঽমস্মি’। আমি একমাত্র ‘আমি’, এই আমিই ‘আমি’। আমি ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। এভাবে চলতে চলতে তিনি হঠাৎ একসময় তিনি ভয় পেতে শুরু করেছিলেন। মানুষ যেমন ভয় পেলে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে অভয় হতে চায় তিনিও তেমন চিন্তা করলেন। অযাচিত ভয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে সংযত করে নিলেন। তিনি নিজেকে নিজে প্রবোধ দিয়ে বললেন, এক আমি ছাড়া আর যখন বিশ্ব সংসারে আর কোথাও কিছুই নেই তখন অন্য কিছুর থেকে ভয় পাওয়ার কিইবা থাকতে পারে! এভাবে চিন্তা করতে করতে মন স্থির করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে জন্ম নেওয়া সেই অযাচিত ভয়ও ক্রমে চলে গেল। ভয় চলে গেলেও আনন্দময় পরমতত্ত্বের মনে আগের মতো আনন্দ আর ফিরে এলো না। তিনি আনন্দ খুঁজে পেলেন না। একাকীত্ব যেমন মানুষকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে, পরমতত্ত্বের মনেও তেমন ঘটতে লাগল। তাই এক অদ্বৈত পরমতত্ত্বই আবার আনন্দরস আস্বাদনের জন্য আর একটি দ্বিতীয় সত্তাকে ভাবলেন। সেই এক, অদ্বিতীয় ও অখণ্ড আত্মার মধ্যেই একটি পুরুষসত্তা আর একটি স্ত্রীসত্তা শুরু থেকেই নিহিত ছিল। তাঁরা দুটি সত্তা একে অপরকে জড়িয়ে এক হয়ে ছিলেন। একই সত্তার যেন অর্ধেক অংশ পুরুষ, অর্ধেক প্রকৃতি। যে মুহূর্তে পরমসত্তার মনে জেগে উঠল আনন্দময় রস আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা ঠিক তখনই তিনি নিজের দেহকে দুই ভাগ করে নিলেন। দুটি ভাগে বিভক্ত হলো একই সত্তা। অর্থাৎ যিনি পূর্বে এক ছিলেন, তিনিই এবার দুইতে প্রকাশিত হলেন। নবজাত বা পরিবর্তিত দুই সত্তার স্বরূপ ও উৎস এক ও অভিন্ন। নব-বিভক্ত এই দুটি সত্তা প্রকাশিত হলেন পুরুষ ও প্রকৃতি নামে। এঁরা জগত সৃজনে পতি এবং পত্নী। প্রকৃতি পুরুষের অর্ধাংশ, আবার পুরুষ প্রকৃতির অর্ধাংশ। এককে বাদ দিয়ে অন্যে অসম্পূর্ণ। নবরসের আকর রসময় পরম-আত্মা, এরপর থেকে নতুনতর রূপে পুরুষ এবং প্রকৃতি রূপে নিজেকে অভিব্যক্ত করে জগৎ-সৃষ্টি ও জীবজগৎ সৃজনের লীলা-বিলাসে মেতে উঠেছিলেন। পুরুষ ও প্রকৃতির নানাবিধ রূপে মিথুন থেকেই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ও মানুষের উৎপত্তি ঘটতে শুরু করেছিল। এভাবে অব্যক্ত জগৎ ব্যক্ত প্রাণীতে ভরপুর হয়ে উঠলে প্রজাপতি আনন্দিত হয়েছিলেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বৈদিক সাহিত্যে প্রজাপতি হলে প্রজা পালক। বিবাহের ক্ষেত্রেও এই প্রজাপতির বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। বিবাহের পরিসরে নমস্য প্রজাপতি, রঙিন পতঙ্গ প্রজাপতি নয়। ভারতীয় বিবাহের সঙ্গে প্রজননের সম্পর্ক রয়েছে। বিবাহ প্রজাবর্ধনের স্বীকৃতি। তাই বিবাহের সময় প্রজাপতির প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করার রীতি রয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে এই প্রজাপতি কিন্তু চতুরানন ব্রহ্মাও নন। পরবর্তী সময়ে পৌরাণিক যুগে ব্রহ্মার ভিন্ননাম হয়েছে প্রজাপতি। জগৎ চরাচর প্রাণীতে পূর্ণ হলে পরমতত্ত্ব বা ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন। আদি পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করেছিলেন তিনিই স্রষ্টা, আবার তিনিই সৃষ্টি। তিনি পুরুষ, আবার তিনিই প্রকৃতি। ওড়িশার অদ্বৈত ভাবধারায় জগন্নাথ সাক্ষাৎ দারুব্রহ্ম অখণ্ডমণ্ডলাকার পরমতত্ত্ব, তিনি সাক্ষাৎ অদ্বৈত অসীম অব্যক্ত অবাঙ্মানসগোচর অপার্থিব লিঙ্গ-নিরপেক্ষ চেতনাতীত। জগন্নাথ সংস্কৃতিতে পুরুষ ও প্রকৃতিতত্ত্ব দ্বৈততত্ত্ব নয়, বরং তাঁরই অখণ্ডরূপের বৈচিত্র্যমাত্র। বাংলার শাক্তগীতি পদাবলীতে দেবী কালী সম্পর্কেও এমন কথা বলা হয়েছে :

“তুমি পুরুষ কি নারী, বুঝিতে নারি! 
স্বয়ং না বুঝালে তা কি বুঝিতে পারি।”২ 

জগন্নাথের পরমপুরুষ স্বরূপ বা ভাবময় প্রকাশই কালক্রমে সর্বত্রগামী হয়েছে। যুগাচার্য আদি শঙ্কর আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যেই পুরীধামের জগন্নাথকে বিষ্ণুস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রায় লক্ষাধিক সুলক্ষণযুক্ত শালগ্ৰাম শিলার ওপর তৈরি করা হয়েছিল পীঠের আরাধ্য দেবতার রত্নসিংহাসন। বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার পর বিষ্ণুস্বরূপে জগন্নাথ পরমপুরুষ বা ব্রহ্ম ভাবময় দারুবিগ্রহে প্রকাশিত ও প্রচারিত হতে শুরু করেছিলেন ভারতের সর্বত্র। জগন্নাথই হয়ে উঠেছিলেন আদি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত পুরীর গোবর্দ্ধন মঠের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবতা বা পীঠদেবতা তথা পীঠনায়ক। গোবর্দ্ধন মঠের সূত্রেই জগন্নাথের শক্তি দেবী বিমলা হয়ে উঠেছিলেন শ্রীক্ষেত্রের মহাশক্তি পীঠনায়িকা দেবী। কালক্রমে পুরীর শ্রীমন্দির ও জগন্নাথের ওপর অদ্বৈত বেদান্তবাদী শঙ্করপন্থার প্রভাব সামান্য কমলে বিশিষ্টা-দ্বৈতবাদী রামানুজী সম্প্রদায়ের প্রভাব বিস্তার পেতে শুরু করেছিল। এমনকি শ্রীমন্দিরে শিখরেও রামানুজী তিলক আঁকা হয়েছিল। এখনও শ্রী সম্প্রদায়ের রামানুজী তিলক শ্রীমন্দিরে শোভা পায়। রামানুজীরা বিশেষ দ্বৈতবাদকে সমর্থন করেন। তাঁদের মতে জগন্নাথ ও তাঁর সৃষ্টি উভয়েই এক। জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্রের পুরীপীঠের শ্রীমন্দিরে বর্তমানে দৃশ্যমান আসন বিন্যাস অনুসারে জগন্নাথ ও বলভদ্র পুরুষতত্ত্ব বা বিষ্ণুতত্ত্ব। দুই পুরুষতত্ত্বের মাঝে বিরাজমান সুভদ্রা দেবী সাক্ষাৎ প্রকৃতিতত্ত্ব বা শ্রীতত্ত্ব। আচার্য ব্যাসদেব রচিত স্কন্দপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডের মধ্যকার পুরুষোত্তমমাহাত্ম্যম্-এর উনত্রিশতম অধ্যায়ে এই ভাবনার একটি অনন্য শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সমস্ত জগৎ চরাচরের সমস্ত পুরুষই মূলস্বরূপে পরমপুরুষ নারায়ণ ও সমস্ত নারীই মূলস্বরূপে পরমাপ্রকৃতি লক্ষ্মী দেবী :

“ন ভেদস্ত্বস্তি কো বিপ্রাঃ কৃষ্ণস্য চ বলস্য চ।
এক গর্ভপ্রসূতত্বাদ্ব্যবহারোঽথ লৌকিকঃ।।
ভগিনী বলদেবস্য হ্যেষা পৌরাণিকী কথা। 
পুংরূপেণ স্ত্রীরূপেণ লক্ষ্মীঃ সর্ব্বত্র তিষ্ঠতি।।
পুংনাম্না ভগবান্ বিষ্ণুঃ স্ত্রীনাম্না কমলালয়া। 
দেবতির্য্যঙ্মনুষ্যাদৌ বিদ্যতে নৈতয়োঃ পরম্।।”৩

স্কন্দপুরাণ অনুসারে, কৃষ্ণতে ও বলদেবের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। এক মাতৃ গর্ভে উৎপত্তি বলে লৌকিক আচার ব্যবহারে সুভদ্রা বলভদ্রের নিজের ভগিনী, ফলে পুরাণসমূহে এমন রূপের বর্ণনা করা হয়েছে। সমস্ত জগৎময় পুরুষ ও প্রকৃতি রূপে শ্রীপতি ও লক্ষ্মীই সর্বত্র প্রকাশিত। পুরুষমাত্রেই শ্রীবিষ্ণুকে ও নারীমাত্রেই কমলালয়া লক্ষ্মীর চিন্তা করতে হবে, জগন্নাথের সাধকের জন্য এমনই নির্দেশ দিয়েছেন স্কন্দপুরাণকার ব্যাসদেব। ব্যাসদেবের নির্দেশ আরও প্রসারিত, স্বর্গের অমর দেবগণ, মর্ত্যের নশ্বর মানুষ, এমনকি সমস্ত জাগতিক প্রাণীর মধ্যে এক লক্ষ্মী ও বিষ্ণু ভিন্ন আর কিছুই পরমরূপে বিদ্যমান নেই। স্কন্দপুরাণের বর্ণনার প্রায় অনুরূপ একটি ভাব অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি বৈষ্ণব কবি বিশ্বম্ভর দাস রচিত ‌বাংলার ‘জগন্নাথমঙ্গল’ কাব্যে রয়েছে :

“যথায় পুরুষরূপে প্রভু ভগবান।
তথায় স্ত্রীরূপে হন লক্ষ্মী অধিষ্ঠান।। 
পুরুষ মাত্রেই সব হয় বিষ্ণুময়।
স্ত্রীমাত্র কমলারূপ জানিয় নিশ্চয়।।”৪

অর্থাৎ, পুরুষ ও প্রকৃতির বহুভাবময় প্রকাশেই এই অজস্র সংখ্যক জগৎ সংসারে ক্ষণে ক্ষণে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় হচ্ছে। পুরুষ ও প্রকৃতির লীলাখেলায় একটি সৃষ্টির বিনাশ হলে আর একটি নতুন সৃষ্টির সংরচনার শুভারম্ভ হচ্ছে। এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় চলছে মুহুর্মুহু, চলছে অনন্ত কাল ধরে। উৎকলের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ সংস্কৃতি অনুযায়ী জগতের নাথ বা জগতের স্বামী জগন্নাথই সমস্ত অখণ্ড জগৎ চরাচরের সৃজক, স্থাপক, পালক, পোষক, রক্ষক, বিনাশক, লয়কারক। আবার চিরন্তনী শাক্ততত্ত্বে বা প্রকৃতিতত্ত্বের অন্তর্গত বিশেষত পূর্ব-ভারতে প্রচলিত বিষ্ণুক্রান্তা তন্ত্রশাস্ত্রে দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী ভগবতী ভুবনেশ্বরী আদ্যাশক্তি এই দৃশ্যমান জড়-জগৎ সংসার প্রসব করেছেন।৫ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব থেকে সামান্য কীট পর্যন্ত সকলের জননী তিনি। তিনিই বিশ্ব চরাচরের সৃজক, স্থাপক, পালক, পোষক, রক্ষক, বিনাশক, লয়কারক। ভারতীয় ধর্মচিন্তার গভীরতায় কোথাও গিয়ে যেন পুরুষ ও প্রকৃতিতত্ত্বের দুটি সুন্দর ধারণা অভেদ হয়ে যায়। একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।

উৎকলের প্রাচীন ইতিহাস, প্রচলিত কিংবদন্তি ও গৌরবময় ঐতিহ্য অনুযায়ী, উৎকলের রাষ্ট্রদেবতা জগন্নাথই ব্রহ্ম, তাঁর মায়াশক্তি দেবী বিমলা। সশক্তিক এক জগন্নাথই সর্বব্যাপী হয়ে প্রকাশিত হয়ে রয়েছেন। ব্রহ্ম থেকে কীট-পরমাণু সবই জগন্নাথ। উৎকলী জগন্নাথ সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয়, পৃথিবীতে ও পৃথিবীর বাইরে এমন কিছুই নেই যা জগন্নাথ নন, বা যার মধ্যে জগন্নাথ নেই। জগন্নাথই ভৈরব, জগন্নাথই শক্তি দেবী। ওড়িশায় প্রচলিত তান্ত্রিকভাবঋদ্ধ শাক্তচিন্তায় বিশেষত মহানির্বাণতন্ত্র মতে, পুরীর শ্রীমন্দিরের ডমরু আকৃতির রত্নসিংহাসনের বিরাজিত বলভদ্র, সুভদ্রা ও জগন্নাথ তিনজনেই শক্তি, মাতৃরূপা। আবার এখানে শূলপাণি সদাশিবস্বরূপে অধিষ্ঠিত রয়েছেন অনন্ত-বলভদ্র। পুরীতে বলভদ্র শিবমন্ত্রেও শাক্ত ভক্তের পূজা গ্রহণ করেন। তাছাড়া বলভদ্রদেবের বহুভুজ মূর্তিতেও তাঁকে শূলপাণি রূপে দেখা যায়। সেই অনুযায়ীও বলরাম শূলপাণি শিব। শিবের অনুরূপ সাদা গাত্রবর্ণ বলভদ্রের। শক্তিতত্ত্বে শূলপাণি-বলদেবই সাক্ষাৎ দ্বিতীয় মহাবিদ্যা দেবী ভগবতী উগ্রতারা বা নীলসরস্বতী। বলভদ্রদেবের বামে বিরাজিত সুভদ্রা দুর্গা-ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে পূজিত হন। দেবী সুভদ্রাই বিশ্বের সমস্ত মায়াবীজের অধিষ্ঠাত্রী চতুর্থ মহাবিদ্যা দেবী ভুবনেশ্বরী। সুভদ্রা দেবীই শাক্ত একানংশা। সুভদ্রার গাত্রবর্ণ তাই হলুদ। ভগবতী সুভদ্রা দেবীর বামে বিরাজিত নীলাদ্রিক্ষেত্রের অধীশ্বর মহাপ্রভু জগন্নাথ বিষ্ণু মন্ত্রে পূজা পান। তিনি স্বয়ং পরব্রহ্মস্বরূপ নির্গুণ শূণ্যরূপা প্রথম মহাবিদ্যা দক্ষিণাকালিকা। জগন্নাথের গাত্রবর্ণও দেবী কালীর মতো ঘোরতর কালো। অর্থাৎ এই ভাবনার সংশ্লেষ করে বলা যেতে পারে, মাতৃরূপে বলভদ্র স্বয়ং তারা দেবী, সুভদ্রা মাতৃরূপে স্বয়ং ভুবনেশ্বরী দেবী ও জগন্নাথ স্বয়ং মাতৃরূপে দক্ষিণাকালী হয়ে প্রকাশিত হয়েছেন। শক্তি দেবী মহাকালী পূর্ণব্রহ্ম সনাতনী ও মহাপ্রভু জগন্নাথ পূর্ণব্রহ্ম সনাতন। এককে বাদ দিয়ে অন্যকে ধরা যায় না। জল স্থির থাকলেও জল, আবার হেললে দুললেও সেই জলই থাকে, তার কখনও মূলভাব নষ্ট হয় না। জগন্নাথও তেমনই। তিনিই পুরুষ, তিনিই প্রকৃতি। ভারতীয় ধর্ম-সভ্যতায় উপাস্য প্রথম পূজনীয় দেবতাদের মধ্যে একমাত্র পুরুষ দেবতা জগন্নাথকেই এতটা মাতৃময়ী ভাব নিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। ওড়িশার এই ভাবনাটি বঙ্গদেশেও প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষত বঙ্গদেশের সবচেয়ে প্রাচীন কালীক্ষেত্র কালীঘাটের (যা সতীপীঠ) আরাধ্যা কালী দেবীকেও জগন্নাথের সঙ্গে এক করে দেখার প্রচেষ্টা হয়েছে। পুরীধামের জগন্নাথের অবয়বের সঙ্গে কালীঘাটের কালীর মুখাবয়ব মিলিয়ে অনুধ্যানের রীতি তৈরি হয়েছে।৬ উৎকল-বঙ্গে ধীরে ধীরে এমন একটি ভাবনা প্রসারিত হতে পেরেছে যে, জগন্নাথদেবই সমস্ত ভক্তিমান শাক্তের কাছে দক্ষিণাকালী রূপে প্রকাশিত হন। আবার দক্ষিণাকালীই পুরীতে জগন্নাথ রূপে অবস্থান করেন। জগন্নাথের এই অপূর্ব সুন্দর রূপটি অনেকাংশে এই রূপ বর্ণিত হয় : দক্ষিণাকালী-জগন্নাথ পীতাম্বরধারী। তাঁর চতুর্ভুজে শোভা পায় (দুই বাম হাতে) ভীষণ অসি, অসুরের মুণ্ড, (দুই দক্ষিণ হাতে) অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা। তাঁর গলায় শোভা পায় নৃমুণ্ডমালা, বনমালা ও রক্তপুষ্পমালা। জগন্নাথের দুটি ‘চকা চকা’ নয়নের সঙ্গে কপালে জাগে আরও একটি নয়ন, তিনি ত্রিনয়নে শোভিত হন। এই ত্রিনয়ন দেবীর প্রতীক, আবার আনুভূমিক দুটি নয়নের আকৃতি জগন্নাথের অনুরূপ। তাঁর পদে স্থিত জড়ও শিবত্ব পায়। তাঁর রক্তাভ জিহ্বা প্রকাশিত হয় বাইরের দিকে। তাঁর মাথায


This post first appeared on Shabdodweep Web Magazine, please read the originial post: here

Share the post

পুরুষ-প্রকৃতি এবং জগন্নাথ - অভিজিৎ পাল | প্রবন্ধ ২০২২ | Avijit Pal | Article 2022

×

Subscribe to Shabdodweep Web Magazine

Get updates delivered right to your inbox!

Thank you for your subscription

×