ভাতসরা
- কুহেলী দাশগুপ্ত
চিত্র-২
- খাবারগুলো আজ আমি রান্না করব।
পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধার কথায় খানিক চমকে ওঠে সীমা। একমাত্র ছেলে হারানোর কষ্ট নিয়ে শাশুড়ি মা আজ ভাতসরা রান্না করবেন বলছেন!
-- আচ্ছা মা। তুমি যা বলবে।
সীমা জানে মলিনা দাশের কোন কাজে বাধা দেয়া উনি পছন্দ করেন না। শাশুড়ি মা সব সময় একরোখা। নিজের ভেতরকার বয়ে যাওয়া নদীর জোয়ার ভাটার সময়, তল কোনটাই কাউকে বুঝতে দেননি। তবে সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর তার। সীমা বুঝেছিল একমাত্র ছেলের বউ হওয়া ও অনেক চাপের। ওনার মন মেজাজ বুঝে সবটুকু সামাল দিতে হয়। আজকের দিনের শিক্ষিতা বউমা এমন বাধ্য থাকবে, এটা আশা করা উচিত নয়। অনেক অপছন্দের বিষয়ে ও চুপ থাকে সীমা। আসলে ওর বিয়ের পর শ্বশুরমশাই, স্বামী অরিন্দম-এরা কেউই চায়নি সীমা স্কুলে চাকরি করুক।
--কি দরকার? আগে যা করেছ, এখন মন দিয়ে সংসার কর।
শ্বশুরমশাই বলেছিলেন,
--বাবুর যা আয় রোজগার, তাতে তোমার চাকরি করার প্রয়োজন পড়ে না।
একমাত্র শাশুড়ি মা সীমার পাশে ছিলেন।
--তোমরা সবসময় প্রয়োজনের কথা ভাব কেন? এতটা পড়াশুনো করে বউমা কেবল হেঁসেল ঠেলে যাবে! আমাদের সময় ছিল আলাদা। আমরা বেশিদূর পড়াশুনো করিনি। হেঁসেলের ভার নেব ভেবেই তৈরি হয়েছিলাম। আমরা ছেলের বউ আনব শিক্ষিতা,আর চাইব সে সংসারের চাপে গুমরে গুমরে থাক। এটা মানতে পারলাম না। বউমা চাকরি করবে। আমি এখনও অনেকটা সামলে দিতে পারি। তোমাদের কোন অসুবিধে না হলেই তো হোল।
কেউ আর এ ব্যাপারে বাধা দিতে পারেনি। সীমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। তবে প্রতিটা দিন, মাস, বছর পার হতে হতে সীমার বুঝেছিল শাশুড়িমা নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অটল থাকেন। চাপা স্বভাবের। শ্বশুরমশাই গত হবার পর খুব যে ভেঙে পড়েছিলেন, এমনটা কাউকে বুঝতে দেননি। সীমার মেয়ে সিলভি তার ঠামুর কাছেই বেড়ে উঠল। স্কুল, হোমওয়ার্ক, আঁকা, নাচ শেখা -এগুলোর বাইরে বাকি সব ওর ঠামুর তদারকিতে চলেছে। সিলভির এখন নয় বছর চলছে। বাবার খুব ন্যাওটা । অরিন্দমের হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া মানতে পারছে না মেয়েটা । মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠছে, কখনো একদম চুপ হয়ে কি যে ভাবছে! সীমার দাদা, বৌদি, মা এসেছে কয়েকবার। গতদিনের শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ ও মিটেছে। অরিন্দমের সেজখুড়ী, ছোটমা সকলে আছেন। সকলের আদরের বাবু ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে এভাবে চলে গেল। কথায়, আলোচনায় শোকের কথা ই ছাপিয়ে উঠছে। সীমা নিজের ঘরে, সকলের আড়ালে একটু মন খুলে কেঁদে হাল্কা হচ্ছে। সব চেয়ে অবাক হতে হয় মলিনা দেবীর আচরণে। প্রথমে থম মেরেছিলেন। পরে সমস্ত পারলৌকিক কাজের তদারকি করছেন। যে বাবুকে খেতে দেয়ার ভার উনি বৌমার হাতে কখনো ছাড়তে পারেননি, তার বিয়োগ ব্যথায় কতটা মূহ্যমান হয়ে পড়বেন, এটা সবার চিন্তা ছিল। সীমাই বা কিভাবে এতকিছু সামলাবে! অরিন্দমের চলে যাওয়ার পর থেকে মলিনা দেবী একদিনও ভাত খাননি। খই, চিঁড়ে, সুজি, সাবুদানা ভেজানো এসব খেয়েছেন। তাঁর জায়েরা এমন কি সীমার বলাতেও কাজ হয়নি।সেই এক কথা।
-- আমার শরীর, আমি বুঝব।
আজ অরিন্দমের উদ্দেশ্যে ভাতসরা দেয়া হবে। সকাল সকাল সেজ কাকা বাবু তার ছেলে অনিন্দ্য অনেক বাজার সেরেছে। মলিনা দেবী আলাদা করে পাঁঠার মাংস আনতে দেওয়ায় সেজখুড়ী, ছোটমা সকলে হা হা করে ওঠেন। প্রেতের উদ্দেশ্যে ওসব দিতে নেই। একথা সীমাও জানে। সকলে এটাও জানে মলিনা দেবী কারো কথা শুনবেন না।
-- এই তো শেষবার খেতে দেবো। ও যা খেতে ভালোবাসে, সবটাই দিতে চাই।
যিনি স্বামী গত হওয়ার পর থেকে কখনো আঁশবটিটা ও ছোঁয় নি, তিনি ছেলের জন্য মাছ, মাংস সব রাঁধবেন। অবাক হওয়ার কথা। সকলে কানাঘুষো করলেও সামনে কিচ্ছুটি আর বলে না। সেই দুপুর থেকে এক সন্তান হারা মা মৃত ছেলের জন্যে কত কি রাঁধছেন! এ দৃশ্য চেয়ে দেখার নয়। সীমা সব কিছুর জোগান দিয়ে চলেছে। তেল, নুন, মশলা যা লাগবে হাতের কাছে। একে একে ডাল, সব্জি, ছানার ডালনা, চিংড়ি মালাইকারি, ইলিশ ভাপা, চিতল কালিয়া, পমফ্রেট ভাজা, সর্ষে ট্যাংড়া, পাঁঠার মাংস কষা, পায়েস, মালপোয়া, নারকোল নাড়ু, ছানার জিলিপি কিছুই বাদ যায় না। মলিনা দেবী খুব ঘামছিলেন। সেই সন্ধ্যে অবধি রান্না চলল। শ্রাদ্ধের কাজ সীমা করলেও ভাতসরা বাড়ির বাগানে মাথায় বয়ে নেয় অরিন্দমের খুড়তুতো ভাই অনিন্দ্য। গোবর ও গঙ্গা জলে নিকোন জায়গায় সব নামিয়ে একটা প্রদীপ জ্বেলে রাখা হোল। সীমা ও সিলভি কান্না ভেজা গলায় অনেক অনুনয়, বিনয় করে ডাকলো। মলিনা দেবী দূর থেকে সকলকে ডেকে নিলেন। এ খাওয়া দিয়ে পিছু ফিরে তাকাতে নেই। সকলে দরজার কাছে এগিয়ে এলে মলিনা দেবী মাথা ঘুরে চৌকাঠে বসে পড়েন। ঘামে জামা কাপড় সব ভেজা। সবাই ওনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছোটকা গেলেন নিবারণ ডাক্তার কে ডাকতে। কেউ জানলো না পাড়ার সেই খোঁড়া নেড়ীটা এসে খেয়ে গেল। পরদিন সকালে সীমা ই গেলো দেখতে সবার আগে। কেবল মাংস আর পায়েসের সরা দুটি চেটেপুটে সাফ করা। বাকি সব কিছুই যেমন দেয়া হয়েছে তেমনটি রয়েছে। ফাইফরমাশ খাটা বিল্লুকে দিয়ে সব পরিষ্কার করিয়ে পুকুরে ফেলার পর স্নান সেরে আসতে বলল সীমা। ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বারণ করে দিলো, কাউকে যেন কিছু না বলা হয়।
মলিনা দেবী একটু বেলায় জাগলেন। মাথাটা ভার হয়ে আছে। সেজখুড়ী, ছোটমা সকলে এসে কাছে বসেছে।
- কেন যে দিদি এতো অনিয়ম করলে! এখন বয়সটা বেড়েছে তো না কি!
ছোটর কথায় কোন জবাব না দিয়ে মলিনা দেবী জানতে চান,
-- বাবু সবটা খেয়েছে তো?
- হ্যাঁ মা। একদম পরিষ্কার করে। আমি জায়গা ও সাফ করিয়ে নিয়েছি।
সীমার কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বৃদ্ধা মা।
কুহেলী দাশগুপ্ত | Kuheli Dasgupta
ভাত সরা | চিত্র - ১ | কুহেলী দাশগুপ্ত | গল্প ২০২২ | Bangla Galpa | Kuheli Dasgupta | Story 2022
অসময়ের গল্প কথা - কুহেলী দাশগুপ্ত | মুক্ত গদ্য | Kuheli Dasgupta
বিড়ম্বনার উপহার - কুহেলী দাশগুপ্ত | গল্প ২০২২ | Story 2022
আলোচনায় ফেরা - শওকত নূর | গল্প ২০২২ | Shawkat Noor | Bangla Galpa | Story 2022
স্বপ্ন যখন একটা সাইকেল | সৎ সাহস - মনসুর আলি | গল্প ২০২২ | Bangla Galpo | Story 2022