অন্য মা (পর্ব - ১৫)
- প্রবোধ কুমার মৃধা
দিলীপ পাকাপাকি ভাবে ফিরে এল। বাড়িতে ঢুকে দেখল বাবা শুয়ে আছে। ভাবল, এখন শুয়ে কেন! মাসিকে ধারে কাছে দেখতে পেল না, হয়তো কোন প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে থাকবে। ঘরের দরজাটা টেনে দেওয়া ছিল। ঘরে ঢুকে ব্যাগ দুটো রেখে, পোশাক পাল্টে বাইরে এল। হাতমুখ ধুয়ে বাবার কাছে বসে গায়ে হাত দিয়ে দেখল জ্বর। নিচু স্বরে ডাকতেই রতন সাড়া দিয়ে চোখ চাইল। চিনতে পেরে চোখ দুটি উজ্জ্বল হলো তার।
'জল খাবে?'
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল রতন। পাশে গ্লাসে জল ঢাকা ছিল। একটু উঁচু করে তুলে ধরে খাইয়ে দিল দিলীপ। দিলীপ বাবাকে জিজ্ঞেস করল,'মাসি কোথায়?' ক্ষীণ অথচ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে রতন জানাল, 'চলে গেছে!' শুনে দিলীপের মনটা দমে গেল। পরে চিন্তা করল, সেটাই তো স্বাভাবিক। নিজের ঘর সংসার ছেড়ে কতদিন আর এখানে থাকা সম্ভব। এমন সময় বিন্দুর মা এল। এক গ্লাস গরম দুধ আর খান কয়েক রুটি নিয়ে। সামনাসামনি কথা বার্তা না হলেও সবাই সবাইকে অল্প অল্প চেনে। কাজের ক'দিন আসতে যেতে দিলীপ বহুবার ভদ্রমহিলাকে দেখেছে। তবে কমলা দিলীপকে দেখলে ও পরিচয় জানত না।বিনতা ও তেমন কিছু বলেনি। বিন্দুর মা দিলীপকে জিজ্ঞেস করল, 'এখন কেমন আছে?'
উত্তরে দিলীপ জানাল যে, জ্বরটা কিছুটা আছে।
'আমি সকালে দেখেছিলাম বেশ জ্বর ছিল। ডাক্তার বদ্যি একবার দেখানো দরকার। আজ বিকেলে কলোনিতে একজন ডাক্তার বসে। আমার সঙ্গে বিকেলে নিয়ে গেলে ভালো হয়।আর তুমি এবেলা খাবে কী? দুটো ভাত পাঠিয়ে দেব?'
ইতস্তত করে দিলীপ বলল, 'না, না তার দরকার হবে না। আমি ব্যবস্থা করে নেব।'
বিকেলে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে আর জ্বর আসেনি। রাতে রতন ভাত খাবে, টুকটাক বাজার করতে হবে; প্রস্তুত হচ্ছিল দিলীপ। এমন সময় একজন বাড়িতে এল। দিলীপ চেনে না। রতন ছেলেকে বলল, 'তোর মামাকে একটা জায়গা দে।' বিভাস বসতে বসতে বলল, 'ছেলে কবে এসেছে।'
'ও আজ সকালেই এসেছে, এবার বাড়িতেই থাকবে, আর যাবে না।'
'তারপর এখন কেমন আছ।'
'অনেকটা ভালো আছি আজ। কামাই হয়ে যাচ্ছে, কবে কাজে যেতে পারব জানি না।'
'ছেলে তো বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে, ওকে এবার কাজে ভর্তি করে দাও।'
দিলীপের এখন যেন আবছা মনে পড়ছে, বাবার খুঁজে প্রথম যেদিন গেঞ্জি কারখানায় গিয়েছিল, তখন মানুষটিকে দেখেছিল।সে আজ কতদিনের কথা।
'আমি তো এখন যেতে পারছিনে, তুমি একটা ব্যবস্থা করে দিও।' বলল রতন। বিভাস এই প্রথম রতনের বাড়িতে এল। বেশিক্ষণ বসল না। কথায় কথায় উঠে পড়ল। দিলীপও বাজারের উদ্দেশ্যে বিভাসের সঙ্গই বেরিয়ে গেল।
দিলীপ বাড়িতে আসার পর থেকে দেখছে বিন্দুর মা বলে ভদ্রমহিলা তাদের অনেক প্রয়োজন মেটায়। নিশ্চয় ব্যাপারটা মাসির আমল থেকেই ছিল।বিনতা থাকতে বিন্দু দুবেলা আসত। এখন আর আসে না। কোন এক দিন বিন্দু মায়ের নির্দেশে তাদের বাড়ির কিছু সবজি ও ফল রতন কাকুকে দিতে এসেছিল। দিলীপ তখন বাড়িতে ছিল। বিন্দু কিন্তু এক মুহূর্ত দাঁড়ায় নি, সবজিগুলো রেখে দিয়েই যেমন এসেছিল তেমন চলে যায়। রতন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল বটে, কিন্তু আগের মতো শক্তি সামর্থ্য ফিরে পেল না। দিলীপ এখন নিয়মিত কারখানার কাজে যায়। বাড়িতে ও অনেক কাজ করতে হয়। ধীরে ধীরে সে সবেতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।
হঠাৎ করে রতনের বয়সটা অনেকটা বেড়ে গেছে বলে মনে হয়। বিগত কয়েক মাস আগের রতন আর আজকের রতনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়েছে। সকাল বিকেল বাড়ির মধ্যে দু-দশ পা হেঁটে বেড়ায়। মুখের রুচিটা আজও ফিরল না, তেমন খেতেও পারে না। দিলীপ কাজে বেরিয়ে গেলে সারা দিনটা একা একা বেশির ভাগ সময়টা শুয়ে বসে কাটায়। মনে পড়ে অনেক কথা।বাবা মা বেঁচে থাকার সময়ের সেই শৈশবটা আজকাল স্মৃতিতে ভেসে ওঠে বার বার।বাল্যের সেই নিশ্চিন্ত আনন্দভরা স্বাধীন দিনগুলো ঘুরে ফিরে এসে স্মৃতি ভারাক্রান্ত করে।সম বয়সী বন্ধু বান্ধবদের সাথে হুল্লোড়ে কাটানো দিন, রাতে দূর-দূরান্তের যাত্রা-পুঁতুল নাচের আসর! সব রাতে ভালো ঘুমাতে পারে না সে। আজ যারা নেই, সেই সমস্ত একদা পরিচিত আপনজনেরা প্রায় স্বপ্নে এসে দেখা দেয়, স্বপ্ন ফুরিয়ে গেলে মনটা অসীম শূন্যতায় ভরে যায়। নিজের অজান্তে কখন দু-ফোঁটা জল দু'চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে নামে।কোন কোন রাত কেটে যায় ছোট সুপেটার অতীতের ছোট ছোট বিক্ষিপ্ত ঘটনার স্মৃতি রোমন্থনে। অঞ্জনার স্মৃতি তার কাছে বহু আগেই ধূসর হয়ে গেছে -প্রেমহীন সেই দিনগুলো এখন রতনের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। আর ভাবতে পারে না রতন, মাথাটা ভার হয়ে আসে। সামান্য চিন্তার ধকলে সে হাঁপাতে থাকে।
প্রবোধ কুমার মৃধা | Probodh Kumar Mridha
অন্য মা (পর্ব - ১৪) - প্রবোধ কুমার মৃধা | গল্প ২০২২ | Bangla Galpo | Story 2022
নিছক, কথার কথা নয় - শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ | প্রবন্ধ ২০২২ | Shibaprasad Purakayastha | Article 2022
মনের বিচিত্র গতি - শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ | প্রবন্ধ ২০২২ | Shibaprasad Purakayastha | Article 2022
চিরদিনের | নীরব ব্যথা | মন্দের ভাগী | পারিশ্রমিক | সুপ্ত ব্যথা | কবিতাগুচ্ছ ২০২২ | Poetry 2022
কবিতা কি ও কেন এবং তার ইতিহাস - প্রবোধ কুমার মৃধা | প্রবন্ধ ২০২২ | Article 2022