নিজস্ব প্রতিবেদন: চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে উত্তরপ্রদেশের কাশীতে। তিনি অন্নদাত্রী নামেই অধিক পরিচিত, অর্থাৎ তাঁর একহাতে অন্নপাত্র এবং অন্যহাতে হাতা বা চমচ। অন্ন দিয়ে যিনি সাধারণের দুঃখ মেটান তিনিই অন্নপূর্ণা।
Related Articles
কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসার গ্রন্থ ছাড়াও অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য নিয়ে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচনা করেন ‘অন্নদামঙ্গলকাব্য’। কথিত আছে, অন্নপূর্ণার পূজা বঙ্গে প্রথম প্রচলন করেন নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার। দেবীর কৃপায় ভবানন্দ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে রাজা উপাধি লাভ করেছিলেন। এছাড়া বঙ্গে দুই বনেদি পরিবারের প্রতিষ্ঠিত অন্নপূর্না মন্দির, যা বছরের পর বছর ধরে প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ কলকাতার বড়িশায় সাবর্ণ চৌধুরীদের বহু ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, তারমধ্যে অন্যতম অন্নপূর্ণা মন্দির। রায় চৌধুরীদের সুসন্তান নন্দদুলাল রায় চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র রাঘবেন্দ্র-ই প্রথম যিনি ‘বড়িশাধিপতি’ খেতাব ব্যবহার শুরু করেন। রাঘবেন্দ্র’র একমাত্র সন্তান তারিণীচরণ, যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বড় বাড়ির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এক বাজার বসান।
অতীতে তা সাপ্তাহিক হাট কিংবা জমিদারের খেয়ালে বাজার হিসাবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে নাম হয় ‘সখের বাজার’।তারিণীচরণের পুত্রদের মধ্যে শুধুমাত্র রামকুমার, কালীকান্ত এবং চন্দ্রকান্তের বংশই রক্ষা পেয়েছিল। চন্দ্রকান্ত দুবার বিবাহ করেও, বংশ রক্ষা না হওয়ায়, তিনি সাবর্ণ পাড়ার যদুনাথ রায় চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র রাজেন্দ্রকুমারকে দত্তক নেন। রাজেন্দ্রকুমারের সাবালকত্ব অর্জনের পর বিবাহ হলে তাঁর হারাধন নামে এক ছেলে জন্মায়।
কয়েক বছর পর সেও মারা গেলে চন্দ্রকান্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এছাড়া তাঁর দুই স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর পুর কাশীবাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে চন্দ্রকান্ত আনুমানিক ১৮৫০-৬০ সাল নাগাদ তাঁর বাড়ির উঠোনে দেবী অন্নপূর্ণার এক পঞ্চরত্ন মন্দির ও জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রকান্ত রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ৩০০ ভরি ওজনের সোনার অন্নপূর্ণা বিগ্রহ ১৯৫৬ সালে মন্দির থেকে চুরি হয়ে যায়। কিন্তু প্রায় ১মন ওজনের রজত-নির্মিত শিব আজও বর্তমান।
উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালে তাঁরাকুমার রায় চৌধুরীর বংশধরেরা জরাজীর্ণগ্রস্ত মন্দিরের সংস্কার করে নতুন মন্দির নির্মাণ করেন এবং অষ্টধাতুর দেবী বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের অন্নপূর্ণা মন্দিরের বয়স ১৭৩ বছর অতিক্রান্ত, আজও নিষ্ঠার সঙ্গে মায়ের পুজো হয়।বলা বাহুল্য, প্রতিবারই অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণীর বাৎসরিক পূজা সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় বড়িশার বড় বাড়ীতে। সকালে মঙ্গলারতির পর বিশেষ পূজা শুরু হয়।
শহর কলকাতায় এমন প্রাচীন মন্দির খুবই বিরল। বিশেষ পূজার দিন দেবীকে দশ রকমের মাছ, দশ রকমের তরকারি, সাদাভাত, পোলাও, খিঁচুড়ি, পায়েস, দই এমনকি নানান রকমের মিষ্টি নিবেদন করা হয়। একইসঙ্গে চৌধুরী পরিবারে এদিন অন্নকূট উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, প্রায় একশো কেজি চালের অন্নকূট হয়। এছাড়া বলিদানের প্রথাও রয়েছে এই পরিবারে। এছাড়া, সন্ধ্যায় নিত্য-গীত-বাদ্যাদি রাগসেবা হয় মূল মন্দিরে।
শ্রীশ্রীদেবীমাহাত্ম্য পাঠ ও ১০৮দীপদান প্রথাও রয়েছে এই পরিবারে।কলকাতার পাশাপাশি উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাকপুর-টিটাগড় অঞ্চলেও এক প্রাচীন অন্নপূর্ণা মন্দির রয়েছে। অতীতে এই অঞ্চলের নাম ছিল চানক। তাই এই মন্দির চানক মন্দির নামেও পরিচিত।
বারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দির অবিকল দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের মতন দেখতে। এর একটা বড়ো কারণ হল, এই দুই মন্দিরের স্রষ্টা একই রাজ পরিবারের। বারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দির নির্মাণ করেন জানবাজারের রানি রাসমণির কনিষ্ঠা কন্যা তথা মথুরমোহন বিশ্বাসের পত্নী জগদম্বা দেবী। ১২ এপ্রিল ১৮৭৫ সালে।