শমীতা দাশ দাশগুপ্তের হরর গল্প চাঁদপানির বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট পড়ুন। গল্পটি সুখী গৃহকোণ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
Related Articles
কাকলি ঠিক করল পালাবে।
আজকের দিনে, এত বড় শহরের বুকে বসে এমনটি যে হতে পারে ও কল্পনাও করেনি। বিয়ের আগে থেকে অজেয়র মুখে শুনেছে ওদের বাড়ির কাক-পক্ষীটিও নাকি মুক্তমনা। ওরা যুগের সঙ্গে শুধু পা মিলিয়ে চলে না, এগিয়ে থাকে। ফ্যামিলি নিয়ে অজেয়র অহংকার ছিল খুব। অবশ্য তা খোলাখুলি প্রকাশ করার মতো অমার্জিত ও নয়। তবু, ঠেস থাকত কথার সুরে।
অজেয়র গুমোর চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহস ছিল না কাকলির। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে মনে হয়েছিল সত্যিই, গর্ব করার মতো ফ্যামিলিই বটে। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে সেই অপূর্ব ভাবমূর্তিটা কেমন যেন টসকে গেল।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই অজেয় দাবী করত ওর দিনপঞ্জী — কোথায় গেল, কার সঙ্গে গেল, কেন গেল। কোন পুরুষ প্রফেসরের সঙ্গে কথা বললেও হিংসে করত। প্রথম প্রথম কাকলি ভেবেছিল এ হল প্রেমের আতিশয্য, সময়ে কমে যাবে। কমা তো দূরের কথা, বিয়ের পরে ব্যাপারটা আরও বেড়ে গেল। সারাদিনে যখন তখন ফোন, অফিসে মিটিং বা কাজে ব্যস্ত আছে বলে ধরতে দেরি হলে জবাবদিহি। পছন্দসই উত্তর না পেলে সাতদিন কথা বন্ধ, বিছানা থেকে বিতাড়িত। ধীরে ধীরে নিজের থেকেই বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়ল কাকলি। বাপেরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ তো আগেই গেছে। অসহ্যবোধ হওয়ায় কয়েকবার ছেড়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছে। কিন্তু কোথায় যাবে? বাপেরবাড়ি? কাকলির বিবাহিত জীবনের গোড়াতেই গলদ। একুশ বছর বয়সে এম এ পাশ করার আগেই, ব্রহ্মতেজ পূর্ণ জ্যেঠা-বাবার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যখন নিজের জন্যে অব্রাহ্মণ ‘সাহা’ পাত্র বেছে নিল, বাপের বাড়ির সকলে ত্যাজ্য করেছিল। সে বাড়ির দরজা এখনও বন্ধ। কয়েক বছরের মধ্যে অজয়ের ব্যবহার স্বাভাবিক স্বামীসুলভ যত্ন বলে মেনে নিয়েছিল ও।
বিয়ের সাত বছরের মাথায়, কোন নোটিস না দিয়ে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে অজেয় চলে গেল। কাকলি তখন এক বহুজাতিক আই টি কোম্পানিতে কাজ আরম্ভ করছে। খুশি হয়েছিল অজেয়, তবে খেয়াল খবর করার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথম মাসের মাইনের চেকটা ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে তুলে নিয়ে বলেছিল, ‘এটা পরে কাজে লাগবে।' অ্যাকাউন্টটা কোন ব্যাঙ্কে করেছে তা জানায়নি পর্যন্ত। কাকলির বরাদ্দ সপ্তাহের হাতখরচ একই রয়ে গেছে। একবার সাধ হয়েছিল একটা বাচ্চাকাচ্চার, ‘সে সবের অনেক সময় আছে' বলে অজেয় উড়িয়ে দিয়েছিল ইচ্ছেটা। শাশুড়িও কখনও বলেননি একটা ‘কচিকাঁচা’ আসার কথা।
অজেয় চলে গেল। অবিশ্বাস আর শোকের ঘোরে কয়েক মাস কেমন করে কেটেছে আর মনে পড়ে না ওর। চারদিক ফাঁকা। অজেয় নেই! আর কোনও দিন ফিরবে না! নিমেষে জীবন থেকে রূপ-রস- গন্ধ হারিয়ে গেল। কিন্তু তাও কি বুকের মধ্যে একটু স্বাধীনতার বাঁশি বাজেনি? গভীর অপরাধবোধে সেই অনুভূতির দিকে খোলাখুলি তাকাতে পারেনি কাকলি।
দিনগুলো হু হু করে কাটছিল, আবার একেবারেই থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। শেষে অচলাবস্থার অবসান ঘটালেন শাশুড়ি। কাকলি যখন ঠিক করছে এবারে চাকরিতে ফিরে যাবে, এক দুপুরে শপিং ব্যাগ হাতে উনি ঘরে ঢুকলেন। ব্যাগের গায়ে পরিচিত দোকানের নাম। বিছানায় বসে প্যাকেটটা ওর হাতে দিয়ে, চোখে আঁচল চাপা দিলেন। অবাক হয়ে ব্যাগ খুলেছিল কাকলি। ভেতরে চারটে শাড়ি— দুটো সাদা আর দুটো কোরা রঙের। সরু পাড়। সঙ্গে ম্যাচিং সাদা ব্লাউজ। পোশাক যে পালটানো দরকার, তা ওর মাথায় আসেনি। শাশুড়ির চোখে চাপা ভৎসনা। একটু কঠিন গলায় বললেন, ‘অন্তত একটা বছর একটু সংযম করলে পার। আমরা একটা সমাজে বাস করি।' এই প্রথম সমাজ নামক বস্তুটির উল্লেখ করলেন কাকলির ‘প্রগতিশীল’ শাশুড়ি।
দাঁতে ঠোঁট কেটে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে শাড়িগুলো আলমারিতে তুলে রাখল ও। একটা বড়সড় সিদ্ধান্তর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। এখান থেকে কিছুদিন পালাতে হবে। কিন্তু একা একা কোথায় যাবে? সমুদ্র ওকে টানে। দীঘা বা পুরী? আজকাল বাঙালিদের ভ্রমণ প্রীতির ঠেলায় কোথাও এক ফোঁটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া মুশকিল। সমুদ্রের ধারে-কাছে একটা সাধারণ হোটেলে ঘর পেতেও কয়েক মাস লেগে যাবে। একা মেয়ে, একটু ঠিক ঠাক হোটেল চাই। https://boierpathshala.blogspot.com/
মুশকিল আসান করলেন অফিসের এক সিনিয়ার কলিগ। দীঘার থেকে মাত্র দশ-বারো কিমি দূরে চাঁদপানি। জনতা এখনও আবিষ্কার করেনি বলে যথেষ্ট নির্জন। অবশ্য সেই নির্জনতার মাশুল হল কোনও ভালো হোটেল নেই। একটা মাত্র ‘রিসর্ট,’ নাম শঙ্খবেলা। ইন্টারনেটে শঙ্খবেলার চেহারা দেখে শিউরে উঠল কাকলি। ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ি, গায়ে অশত্থ গাছ গজিয়েছে। ওর মুখের অবস্থা দেখে সিনিয়ার দাদা হেসে ফেললেন।
‘নাঃ, ওই রিসর্টে আরশোলা ছাড়া কেউ থাকে বলে মনে হয় না। আমার এক বন্ধুর বাবা-মা আছেন ওখানে। ছেলে-মেয়েরা দূরে থাকে বলে একটা বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট খুলেছেন। কম্পাউন্ডের ভেতরেই ছোট গেস্ট হাউস।'
কাকলির সন্দেহ দেখে আস্বস্ত করলেন, ‘নতুন রেনোভেট করা। মডার্ন বাথরুম, ছোট্ট কিচেন। চার্জ খুবই রিজনেবল। আর তুমি যা চাইছ তাই। একেবারে সমুদ্রের ধারে।”
আর বেশি খুঁতখুঁত না করে রাজি হয়ে গেল কাকলি। এক সপ্তাহে কী আর হতে পারে! শাশুড়ি আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু ওর অনমনীয়তা দেখে সরে গেলেন। ওলা ডেকে স্টেশনে যাবার সময় ঘর থেকে বেরোলেন না।
দীঘা থেকে চাঁদপানি সাইকেল রিকশায় ১৫০ টাকা। পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে গেল। বাড়ির নাম শুনে রিকশাওয়ালা তাকাল ওর দিকে।
“হুই বাড়ি কেউ আইসে না, দিদি। একাই থাইকবেন?” সাবধান হল কাকলি। জেনে কী লাভ লোকটার? https://boierpathshala.blogspot.com/
‘না, কাল আরও দু’জন আসবেন। তাছাড়া মাসিমা মেসোমশাই অনেক দিনের চেনা।'
এক গাল হাসল রিকশওয়ালা। ‘অঃ, তাঁদের সঙ্গে শুইবেন, থইলে কুনো ভাবনা নাই।'
ভাবনা, কীসের? আসলে সকলেই মেয়েদের মরাল গার্জেন। রিকশওয়ালার সঙ্গে বেশি আত্মীয়তা না পাতিয়ে ওভারনাইট ব্যাগ হাতে বাড়ির সামনে নামল কাকলি। রাস্তার ওপারে সমুদ্র, ঝাউগাছের সারি, আগে দীঘায় যেমন ছিল। এপারে, রাস্তা থেকে খানিকটা ভেতরে সরিয়ে ছোট্ট একতলা বাড়ি, কোমর সমান পাঁচিলে ঘেরা। সাদা রঙের কাঠের গেট খুলে, সরু পায়ে-চলা পথ ধরে এগল কাকলি। পথটা শেষ হয়েছে হলুদ রঙের দরজায়। কম্পাউন্ডের ভেতরেও ঝাউবন। খানিক দূরে আরেকটা একতলা বাড়ি – নতুন কলি ফেরানো হয়েছে। নিশ্চয় গেস্ট হাউস। ভারি সুন্দর! মনটা খুশি হয়ে উঠল।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে গেস্ট হাউসে যেতে অন্ধকার নামল। ততক্ষণে তাঁরা মাসিমা-মেসোমশাই হয়ে উঠেছেন। মেসোমশাই টর্চ হাতে সঙ্গে এলেন। দুজনেই অনুরোধ করেছিলেন সেই রাত তাঁদের বাড়িতেই থেকে যেতে। কাকলি রাজি হয়নি। এখানে এসেছে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে! সে ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করতে ও নারাজ। দরজায় পৌঁছে দিয়ে মেসোমশাই জানালেন কোনও অসুবিধে হলে তাঁদের ডাকতে যেন কাকলি ইতস্তত না করে। সামনের বারান্দায় একটা ভারী ঘণ্টা দেখিয়ে বললেন, ‘দরকার হলে বাজিয়ে দিও, চলে আসব।'
বাঃ, দূর থেকে ডাকবার সহজ উপায়!
একা হওয়ার জন্যে কাকলি আঁকুপাঁকু করছিল। ঘুরে ঘুরে দেখল ওর অস্থায়ী আবাস। শোওয়ার ঘর, ইন্ডাকশান স্টোভ সমেত ছোট্ট রান্নার জায়গা – কাপ ডিস, টি-ব্যাগ, গ্লাস, চামচ, দুটো জলের বোতল। টেবিলে রাখা ঝুড়িতে কয়েকটা ফল। সবকিছু ওরই জন্যে সাজিয়ে রাখা। বিছানার পাশে টেবিলল্যাম্প, বেডসুইচ। অ্যাটাচড বাথরুমে তোয়ালে, সাবান। সবকিছু ঝকঝকে, তকতকে। আর কী চাই!
এখানে আসার সময়ে এটা ওটা খেয়েছে, তারপর মাসিমার কাছে চা আর মিষ্টি। রাত্রে কিছু না খেলেও চলবে। ইচ্ছে করছিল সমুদ্রের ধারে হেঁটে আসে কিছুক্ষণ। কিন্তু জায়গাটা ভালো চেনে না, অন্ধকারে না বেরনোই ভালো। জামা-কাপড় পালটে একটা বই নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল ও। এতদিনের ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে বিছানায় শুয়ে এক পাতা পড়তে না পড়তে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে, হঠাৎ টপ করে খুলে গেল চোখের পাতা। কাকলি বুঝতে পারল না কোথায় রয়েছে। ঘর অন্ধকার। ঘুমোবার আগে বেডসাইড ল্যাম্পের সুইচ অফ করেছিল কি? ঘুম ভাঙল কেন? সারা শরীর ঘামে ভেজা, যুক্তিহীন আতঙ্কে মন ছেয়ে আছে। নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন দেখছিল!
শোওয়ার সময় সমুদ্রের হাওয়ায় ঘর ভাসছিল, পর্দাগুলো উড়ছিল আলুথালু। হাওয়া থামেনি, এখনও দুর্বার গতিতে বয়ে চলেছে। মনে পড়ল একটু আগে কে যেন ওকে বলছিল ফিরে যেতে! গমগমে, গম্ভীর, ভয় পাইয়ে দেওয়া গলা। নিশ্চয়ই গভীর উদ্বেগ খেলা করছে মনে! অজেয়কে হারিয়েছে, শাশুড়ির আপত্তি অমান্য করেছে, সেই অপরাধবোধেই দুঃস্বপ্নের আগমন? ভেতরে চাপ পড়ছে ফিরে গিয়ে ‘গুড গার্ল' হওয়ার ?
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল কাকলি। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বাতির সুইচ টিপতে ক্লিক আওয়াজ হল, আলো জ্বলল না। লোডশেডিং? এরপর থেকে টর্চ নিয়ে শুতে হবে। সমুদ্রের জলে চাঁদের আলোর প্রতিফলনে ঘরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। এক গ্লাস জল খেয়ে বাথরুমের দিকে এগল। এখনও কানে বাজছে চাপা পুরুষালী স্বরে সতর্ক বাণী, ‘বাঁচতে হলে ফিরে যাও!' ফিরে গেলে যে বাঁচবে, সেই গ্যারান্টি কোথায়! কিন্তু এত আতঙ্ক কেন! একা বেড়াতে আসার ভয়? প্রতিদিনের খবরদারি সমাপ্ত হবার ভয়? খাঁচার বন্ধ দরজা খুলে গিয়ে স্বাধীনতা হাতে পাওয়ার ভয়? খোলা জানলার দিকে চোখ গেল। সাদা পর্দা হাওয়ায় উড়ছে।
জানলার বাইরে একটা ছায়া-ছায়া অবয়ব, ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে! থমকে গিয়ে, নিমেষে জানলার আড়ালে সরে দেওয়ালে সেঁটে গেল কাকলি। কে দাঁড়িয়ে, সেই রিকশওয়ালা? ও একা আছে জেনে চুরি করতে এসেছে, বা অন্য কিছু? কাকলির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, পাঁজরের খাঁচা ভেঙে হৃদপিণ্ড এক্ষুণি বেরিয়ে যাবে। লোকটা বেশ লম্বা রিকশওয়ালা তো বেঁটে ছিল!
এখন কী করবে কাকলি? বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় ঝোলানো ঘণ্টা বাজাবে? বাইরে? সেখানেই তো লোকটা দাঁড়িয়ে! ভাগ্যিস ভালো করে দরজা বন্ধ করেছে, জানলায় শিক আছে। কেউ সহজে ঢুকতে পারবে বলে মনে হয় না। বেডসাইড টেবিলে সেল ফোন চার্জ হচ্ছে। সেটা কাছে থাকলে অন্তত মাসিমাকে ফোন করা যেত। অবশ্য বুড়ো-বুড়ি কী-ই বা করতে পারবেন! উঁকি মেরে আবার তাকাল কাকলি। উড়ন্ত পর্দার ফাঁকে দেখল বাইরে কেউ নেই। হয়ত ছিঁচকে চোর, ওকে দেখে পালিয়েছে। হাতের মুঠো শক্ত করল কাকলি। আঙুলের নখ হাতের তালুতে কেটে বসেছে। ক’সেকেন্ড অপেক্ষা করে ছুটে শোবার ঘরে গিয়ে কাঁপা হাতে ফোন তুলল। কী নাম... কী নাম ওঁদের? ও হ্যাঁ, ‘চাঁদপানি মিত্র' হিসেবে নাম তুলেছে। নামটা খোঁজার আগেই আলো জ্বলল ফোনের স্ক্রিনে। ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখে কাকলি দেখল একটা মেসেজ ভেসে উঠেছে... ‘এ বাড়ি ছাড়ো... নইলে বিপদ!”
হাত থেকে ছিটকে পড়ল ফোন, সশব্দে মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গেল কোথাও! কে পাঠিয়েছে মেসেজ? চোখের ভুল? হ্যাল্যুসিনেশন? এ ক’মাসের বিপদ ওকে এই ক্রান্তি কালে এনে ফেলেছে! বহু বাধা সরিয়ে চাঁদপানিতে এসেছে কাকলি। সামান্য ভ্রান্তিতে নিজের স্বাধীনতাটুকু হারাতে পারবে না! অত সহজে ভয় পাবে না ও।
কে জানে এখন ক'টা বেজেছে। বাকি রাতটুকু না হয় জেগে কাটিয়ে দেবে। সকালে বোঝা যাবে কী ব্যাপার। বালিশে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুল কাকলি। চারদিক নিস্তব্ধ। পাড়ে ঢেউ আছড়ে পড়ার তাল আর ঝাউগাছের ফাঁকে হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছু কানে এল না। নাকে এল জলের নোনা ঘ্রাণ। টেনশনে টান টান স্নায়ু আলগা হয়ে চোখের পাতা বন্ধ হল টুপ করে।
সকালে আলোর ঝর্ণায় রাতের দুঃস্বপ্ন গেল উড়ে। এমনকী সে কথা মনে পড়তে লজ্জা পেল কাকলি। ওর মনে এত ভয়, কুসংস্কার, লুকিয়ে রয়েছে কোনওদিন বোঝেনি! মাসিমার বাড়িতে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে গল্পে জড়িয়ে পড়ল কিছুক্ষণ। জায়গাটার ইতিহাস মশগুল হয়ে বললেন মেসোমশাই। একসময় এখানে সমুদ্র গভীর ছিল, হার্মাদরা আনাগোনা করত। এখানকার মেয়েদের সঙ্গে তারা অনেক সময় সংসার পেতেছে, আবার আঞ্চলিক জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াইও করেছে। অনেকে আবার বুড়ো বয়সে মাছুয়া জনতার সঙ্গে মিলেমিশে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। ‘এই সেদিন অবধি বালির ওপর জাহাজের টুকরো টাকরা, ভাঙা জিনিসপত্র লোকে খুঁজে পেত। সে সব চিত্রপুরার নৌ-জাদুঘরে জমানো রয়েছে।
‘এই সেদিন’ যে কত বছর আগে তা মেসোমশাই উল্লেখ করলেন না। কাকলির দিন কাটল সমুদ্রের ধারে। বিকেলের রান্নার ঝামেলা এড়াতে দোকান থেকে পাঁউরুটি আর ডিম কিনল। কাল মাসিমাকে বলবে ওঁদের সঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। সন্ধ্যেয় গায়ের নোনা জল আর বালি ধুয়ে দরজার সামনের খোলা জায়গায় বসল চেয়ার পেতে। কালকের মতো আজও ঢেউয়ের ফেনা-ঘেঁষা হাওয়া উড়িয়ে নিচ্ছে ঘরদোর। ঝাউগাছ তেমনই আলোড়িত। কাকলির গলা থেকে আপনা আপনি গান বেরিয়ে এল।
.সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে... তুলনাহীনারে ... ও যে এক সময় গান গাইত তাই ভুলে গেছে। গান গাইলে শাশুড়ি বিরক্ত হন, অজেয়ও পছন্দ করত না। কতদিন পরে গান গাইল কাকলি। কেউ না শুনলেই বা! গান থামতে অন্যমনস্কতা ভেঙে ভেসে এল হালকা হাততালির শব্দ। নিশ্চয়ই ও বাড়ি থেকে মাসিমা মেসোমশাই তারিফ করছেন। ওর গলা অত দূর গেল! বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে ওঁরা আলো জ্বালেননি? অবাক কাণ্ড !
‘কী কাকলি, বাড়িতে বসে যে? বিকেলে হাঁটতে যাওনি?” মাসিমা-মেসোমশাই সান্ধ্যভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরছেন। তাহলে হাততালি দিল কে?
ভয় মেশানো অস্বস্তি চেপে ডিম স্যান্ডুইচে রাতের খাওয়া সারল কাকলি। এখানে আসার পর থেকে যে সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে তার ব্যাখ্যা আছে কী? ওর মনের অযৌক্তিক অপরাধবোধ? নিজের মধ্যেই রয়েছে এই অপরিচিত দুর্বলতা? কিন্তু আর হার মানতে রাজি নয় কাকলি। হার মেনে মেনে জীবনের অনেক কিছু হারিয়েছে। আর নয়।
মাঝরাতে চোখ খুলে গেল আবার। শুয়ে শুয়েই সুইচ টিপল কাকলি, বাতি জ্বলল না। আগের মতই হাওয়ায় পর্দা উড়ছে, চারদিক নিস্তব্ধ। কত রাত এখন? খেয়াল করল ঘরের তাপমাত্রা নেমে গেছে কয়েক ডিগ্রি, শীত করছে। নির্দিষ্ট তালে ঢেউয়ের ওঠাপড়ার শব্দ বেড়েছে অনেক গুণ। ঘরের কোণ থেকে ফিতের মতো সূক্ষ্ম ধোঁয়া বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আগুন? উঠতে গিয়ে চোখে পড়ল খাটের পায়ের দিকে এক আবছা উপস্থিতি। লম্বা লোক, কেমন বেখাপ্পা জামাকাপড় পরা...; ওর দিকে তাকিয়ে। কাকলি তো ভূতে বিশ্বাস করে না!
কেন এসেছে? গলা শুকিয়ে কাঠ, স্বর বেরোচ্ছে না। ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে ঘর। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ধড়মড় করে খাটে উঠে বসল কাকলি। কেউ নেই! ঘর ধোঁয়াহীন, তাপমাত্রা আগের মতই। তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিল? আবার?
জলের বোতল তুলে গলায় ঢালতে গিয়ে চাপা চিৎকারে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটা। জল নয়, কালচে রঙের তরল রয়েছে, বি