আবহাওয়ার বৈরিতায় বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে। ফলে বজ্রপাতে হতাহতে দেশবাসী শংকিত। দেশের গণমাধ্যমে জানা যায়, বজ্রপাতে দু’দিনে সারাদেশে কম হলেও ৩৫ জনের মৃত্যু এবং ২ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। তবে বজ্রপাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা পরিসংখ্যান বা পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে আরো বেশি হতে পারে ।
Related Articles
যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাহতের এ হার ভয়াবহ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, দুর্যোগ ফোরামসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হিসাব অনুসারে গত ৫ বছরে বজ্রপাতে সারাদেশে ৩ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের সূত্র মতে গত ৭ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বজ্রপাতের সংখ্যা এবং হতাহতের পরিমাণ অনেক হারে বেড়েছে। সামুদ্রিক ঝড় ও আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত প্রচার, বন্যার্তদের জন্য আশ্রয় ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থার সংবাদ আবহাওয়া অধিদফতর করে থাকে।
কিন্তু বজ্রপাত ও শীতকালে ঘন কুয়াশার কোনো সংকেত এ দফতর দিতে পারছে না। কেননা আবহাওয়া বিজ্ঞানে এর কোনোই গবেষণার লব্দ বিষয় নেই । মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার প্রায়োগিক কোনো ব্যবস্থা আপাতত: কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু নেই । তবে বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু কারণ বলা সহজ হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির প্রবণতা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। অস্বাভাবিক ক্ষরা,বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াস,প্রকৃতির ভারসাম্যহীন,বৃক্ষ উজাড়, কার্বন-ডাই অক্সাইড নি:সরণ বেশি করতে পারে এমন গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়া ইত্যাদি । প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত বজ্রপাত বৃদ্ধির জন্যও ভ‚-মন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
চলতি গ্রীষ্মের শুরু থেকেই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের সাথে অস্বাভাবিক মাত্রার শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতে প্রাণহানি, ফসলহানি, গাছপালা ও কাঁচা বাড়িঘর ধ্বংসের হার অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বৈশাখি ঝড় ও বৃষ্টিপাত আমাদের দেশে একটি চিরায়ত বাস্তবতা। কিন্তু বৃষ্টির সাথে এ রকম বজ্রপাতে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু একটি উদ্বেগজনক ঘটনা প্রবাহ।
এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের কোনো হাত নেই। বাস্তবতাও ভিন্ন । বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানীর অনিয়িন্ত্রিত ব্যবহার,পরিবেশ দূষণ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও অমিত জীবনযাত্রার সম্পর্ক বিদ্যমান। দেশে হঠাৎ করেই আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ এবং বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টিতে জীবন ও সম্পদহানির পেছনেও প্রায় একই প্রকার কারণকেই দায়ী বলা যায়।
বিশেষত বাতাসের দূষণের কারণে সালফার ও নাইট্রোজেন যৌগের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে আকাশে কালো মেঘ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বজ্রপাত ও এসিড বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বায়ু, পানি, মাটি দূষণ এবং পাহাড় ধসের মত বিষয়গুলো নি:সন্দেহে মানব সৃষ্ট বিপর্যয়। নদী ,বায়ু , পরিবেশ,শব্দ দূষণ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি যানজটসহ নাগরিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে ইতিমধ্যেই দেশের বড় বড় শহর গুলো দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণঘাতি বজ্রপাত বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য অনুঘটক গুলোর সাথে ভ‚-পৃষ্ঠে বসানো ধাতব পিলার চুরি এবং অপরিকল্পিতভাবে বসানো মোবাইল ফোন টাওয়ারকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। রোদে-বৃষ্টিতে নিরলস কাজ করেই দেশের কৃষককরা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করছেন। একইভাবে নানা ঝুঁকি নিয়ে দেশের শ্রমিকরাও দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে বিশেষজ্ঞরা জনসাধারণের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষত: বাড়িতে বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন এবং বজ্রপাতের সময় ধাতব কল, শিঁিড়র রেলিং বা পাইপ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা, বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা, খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় না নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
গ্রীষ্ম-বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে খেটে খাওয়া মানুষের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বজ্রপাতে হতাহত কৃষক-শ্রমিকের জন্য সরকারিভাবে ক্ষতিপুরণের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে জানা যায়। এটি নি:সন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগি পদক্ষেপ।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া এমপি ২০১৭ সালে ‘প্রাণঘাতি বজ্রপাত’কে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই । এরইমধ্যে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যুজনিত কারণে যে ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা দিয়েছেন তারজন্যেও ধন্যবাদ জানাই ।
সম্পাদকীয়
৪ মে ২০১৮
The post বজ্রপাতের হতাহতে দেশবাসী শংকিত appeared first on Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস.