Get Even More Visitors To Your Blog, Upgrade To A Business Listing >>

বাবা, আমি তোমাকে কারাগারে দেখতে চাই না

মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে আছে বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ। বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ ২৮০ ট্রিলিয়ন ডলার, অথচ সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না।

সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধান ডি সিলভা বলেছেন, বিশ্বের ধনী লোকদের খাদ্য অপচয়ের মূল্য সুইজারল্যান্ডের এক বছরের জিডিপির সমান। সংস্থাটির হিসাবে বছরজুড়ে বিশ্বে ১৩০ কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়।

সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে কারো ধমনি-শিরায় মেদ জমছে, কারো শরীর অপুষ্টিতে ভুগছে। মূলত দুর্নীতি থেকেই অসাম্য, অপব্যয় ও অপচয়। দুর্নীতির নেশা মানুষকে একমাত্রিক চিন্তায় বন্দি করে ফেলেছে, ‘রাতারাতি সম্পদ বাড়াও, জীবনকে ভোগ করো।’ অন্তহীন লোভ মানুষের সুস্থ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের শিকড় উপড়ে ফেলছে এবং বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির ডিনামিক্স ওলট-পালট করে দিচ্ছে।

বিশ্বায়ন, বাণিজ্যায়ন ও আধুনিকায়নের ঢেউয়ে সম্পদ আহরণ আর সম্পদ ভোগের যে উন্মাদনা চলছে, তাতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো প্রলোভনের শক্তির টানে মানুষ আছড়ে পড়ছে দুর্নীতির অতলস্পর্শী গহ্বরে। দুর্নীতি ও সততার দ্বান্দ্বিকতা সমাজে বিভক্তির রেখা টেনে দিচ্ছে।

দুর্নীতির নেপথ্যে অনেকাংশে রয়েছে পারিবারিক চাপ। যতই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলা হোক, সংসার নিয়ন্ত্রণ নারীর হাতে। স্ত্রীদের ছকের বাইরে সংসার আবর্তিত হয় না। বিশ্বের শাসন-প্রশাসন-অনুশাসনে পুরুষ অগ্রভাগে থাকলেও অন্তরালে থাকে নারী। যে নারী মুক্তির পথ খুঁজছে, সে নারী চেতনে-অবচেতনে স্বামীর দুর্নীতির শিকার বা অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে যাচ্ছে।

দুদকের অনেক মামলায় দেখা গেছে, স্বামীর অসৎ উপার্জন সঞ্চিত হয়েছে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে। দুদকের ১১টি মামলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিযুক্তরা তাদের স্ত্রীদের ব্যাংক হিসাবে জমা রেখেছেন ২৯ কোটি টাকা।

যে নারী স্বামীর নাড়ি-নক্ষত্রের হিসাব রাখে, তাকে অবশ্যই স্বামীর দুর্নীতির হিসাব জানতে হবে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মীর জাফরের স্ত্রী মুন্নীবেগম কর্তৃক ওয়ারেন হেস্টিংসকে ঘুষ প্রদানের ঘটনা প্রমাণ করে দুর্নীতিতে নারীদের কেউ কেউ অসাধারণ দক্ষ। ফিলিপাইনের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মার্কোসের স্ত্রী ইমেলদার চার হাজার জোড়া জুতোর কাহিনী ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

এভাবে বিন্দু থেকে সিন্ধু এবং স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলে পরিণত হয় দুর্নীতি। সম্প্রতি জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের পতনের জন্য তাঁর স্ত্রীর ‘বিলাসী জীবন’কে দায়ী করা হচ্ছে। ইতিহাস বলছে, শাসনের ভারে ক্লান্ত শাসকরা স্ত্রীর কাছে সঁপে দেয় অনেক কিছু, এ নির্ভরতায় দুর্নীতি হয়ে ওঠে অনিবার্য। যে নারী স্বামীর সততায় প্রেরণা জোগায়, সন্তানকে আদরে ও শাসনে বন্দি রাখে, সে নারী কেন অসৎ উপার্জনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবে না?

চোখ ধাঁধানো অ্যাপার্টমেন্ট, শ্বেতপাথরের বেডরুম, জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে, বিএমডব্লিউর চাকচিক্য, বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে ভূরিভোজন, ডায়মন্ডের আংটি, ওয়্যারড্রোব ভরা স্যুট, টাই, শাড়ি এবং ছুটি কাটাতে ইউরোপ পাড়ি— এসব স্রেফ আর্টিফিশিয়ালিজম ইন লাইফ।

যাদের মন ও মননকে দখল করে রেখেছে দুর্নীতি, এমন এক শ্রেণীর অবিবেচক অভিভাবক অবৈধ ব্যবসা, অনৈতিক মুনাফা ও ঘুষের টাকা সন্তানদের অস্থিমজ্জায় মিশিয়ে দিচ্ছে। এমনকি বিয়ের আগে অভিভাবকের আয় এবং গাড়ি-বাড়ির তথ্য চেয়ে সন্তানকে পদস্খলনের পথে টেনে নিচ্ছে। ফলে সন্তানদের মনে দুর্নীতির প্রতি আকর্ষণ প্রথমে শিকড়, তারপর কাণ্ড এবং সর্বশেষ ডালপালায় প্রসারিত হয়। সম্প্রতি সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, সন্তানকে স্বপ্নের ডাক্তারি পড়াতে কতিপয় বিবেকভ্রষ্ট অভিভাবক প্রশ্ন ফাঁস চক্রের দ্বারস্থ হয়ে ১১ লাখ টাকা করে পরিশোধ করেছেন। অথচ এ অর্থ দরিদ্রদের অর্থকষ্ট মোচনে ব্যয় করলে অনেক মানবিক হতো।

মানুষের মৃত্যুর পর অবৈধ সম্পদ (আবর্জনা!) সন্তানদের ধমনিতে সংক্রমিত হয় বংশ পরম্পরায়। এ নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে চলে লড়াই। নিঃস্ব ও রিক্ত হয়ে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছে অনেক দুর্নীতিবাজের উত্তরাধিকার, এমন দৃষ্টান্তও আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তির চেয়ে নিজের অর্জিত সম্পদের মূল্য অনেক বেশি। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের ওপর নির্ভরতায় সন্তানের মেধা, প্রতিভা ও সম্ভাবনার স্ফূরণ ঘটে না।

ভারতের ডন সম্রাট দাউদ ইব্রাহিমের অপরিমেয় সম্পদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তার একমাত্র সন্তান মঈন নওয়াজ। অথচ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার সৎ উপার্জন তাঁর মৃত্যুর অর্ধশত বছর পরও মানুষের কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সৎ। জন্মগত বা জিনগতভাবে কেউ অসৎ হয় না, কিন্তু পারিবারিক অনুশাসনের অভাবে প্রাকৃতিক এ সমীকরণ ভেঙে যায়।

অর্থ কষ্টের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট থেকেও সাফল্যের শিখরে আরোহণ করেছেন পৃথিবীর খ্যাতিমানরা। বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন বাড়ির পাশের সবজি চাষ করে আয় করেছেন ৩০০ ডলার, যার অর্ধেক মায়ের হাতে তুলে দেন, বাকি অর্ধেক দিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

ট্রেনেও তিনি সংবাদপত্র বিক্রি করতেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম লেখাপড়ার খরচ জোগাতে না পেরে মাছ-মাংসের পরিবর্তে নিরামিষ ভোজী হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ছিলেন বাদাম বিক্রেতা, আব্রাহাম লিংকন ছিলেন পোস্টমাস্টার, জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন সার্ভেয়র।

দুর্নীতিবাজদের শুধু ধরে ধরে একটি সমাজকে দূষণমুক্ত করা কঠিন। মনে পড়ে, শৈশবে ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে সবুজ শেওলার আস্তরণে ঢাকা পুকুরে যখন ভাঙা কলসির টুকরো ছুড়ে মারতাম, তখন সবুজ আস্তরণটি অপসৃত হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে আবারো ঢেকে যেত। এ দৃষ্টান্তটি এজন্য যে, শুধু আইন প্রয়োগ করে দুর্নীতি নির্মূলযোগ্য নয়।

সততার বীজ রোপিত হয় পারিবারিক শিক্ষায়, প্রাতিষ্ঠানিক বা অধ্যয়নিক মাত্রায় সততা শেখানো যায় না। পরিবারে পিতা-মাতার স্বভাব ও আচরণ সন্তান সৎ বা অসৎ হওয়ার পেছনে গভীর ছাপ রেখে যায়।

যে সন্তান বাবার হাত ধরে বড় হয়েছে, তার সামনে বাবাকে যখন দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয়, তখন মিডিয়ায় তার ফলাও প্রচার, দেশজুড়ে সামাজিক নিন্দা, মামলার জালে বন্দি, এ ত্রিমুখী চাপে পুরো পরিবারের মর্যাদা ধুলো হয়ে উড়ে যায়, দুর্নীতির গোপন সব তথ্য একে একে উন্মোচন হয়ে যায়।

দুর্নীতি ধরা পড়া মানে অনন্তর গ্লানিতে একটি পরিবার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। স্বস্তির নিদ্রা, খাবারে রুচি, জীবনের স্থিতি হারিয়ে যাওয়া। স্বাভাবিক জীবনযাপনের চিত্র উল্টে যাওয়া। সন্তানের ভবিষ্যৎ ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া। অবশেষে হূদয় খুঁড়ে যাওয়া বেদনায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া। সুতরাং দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সুফলভোগ নিষ্কণ্টক নয়। এ প্রলয় থেকে বাঁচতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সন্তানদের দাঁড়াতে হবে।

সন্তানরা বাবাদের বোঝাবে, ‘তোমার অনৈতিক অর্থ আমরা ভোগ করব না।’ বাবাদের আয়কে পর্যবেক্ষণে রেখে স্পষ্টবাদিতায় বলবে, ‘বাবা, আমি ঘুষখোরের সন্তান হতে চাই না, তোমাকে কারাগারে দেখতে চাই না। তুমি অসীম আয়ের পথে যাবে না। তোমার আয়-ব্যয়ের হিসাব চাই।’ কিন্তু বাবাদের কাছে অন্যায্য দাবি করা যাবে না।

যে খাবারটুকু খেলে তোমার পুষ্টি ও স্বাদ মিটবে, ততটুকু খাও। যে গাড়িতে চড়লে তোমার চাহিদা পূরণ হবে, তার চেয়ে বেশি বিলাসী গাড়ির আবদার করো না। কষ্টসহিষ্ণু হও, জীবনকে আড়ম্বর মুক্ত রাখো, মিতব্যয়িতার চর্চা করো, পরিমিতিবোধকে ভালোবাস। রাস্তায় রিকশাওয়ালাদের জীবন দেখো, পথশিশুদের পানে তাকাও, প্রান্তিক মানুষের মর্মব্যথা উপলব্ধি করো, তোমার না পাওয়ার বেদনা থাকবে না। ঘাম ঝরিয়ে ঘণ্টা মেপে শ্রমিকরা আয় করে, অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে তোমরা সময় নষ্ট করছ। একান্ত সময়ে সৃষ্টিকর্তার পরিচয় এবং মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করো, যে জ্ঞানের অভাবে মানুষ শুদ্ধ জীবনচর্চার পথ হারায়, অনৈতিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায়।

এ জীবন ঘাত-প্রতিঘাতের। এ পৃথিবী পাঠশালা, প্রতি মুহূর্ত বইয়ের পাতা। জীবনের সূর্য অস্তগামী হওয়ার আগেই প্রয়োজন জীবনের পরিশোধন। অশ্রু, শ্রম ও মেধার বন্ধনে যে অর্জন, তা-ই প্রকৃত উপার্জন।

মেধাবী মাথা ও চৌকস হাতই মানুষের শক্তি। পৃথিবীতে সামাজিক মর্যাদা যত উঁচুই হোক, মৃত্যুর মহাসড়কে আমরা সবাই সাধারণ অভিযাত্রী। মৃত্যুর নির্মম শীতল হাতে যেদিন জীবন সমর্পিত হবে, সেদিন দুর্নীতির সঙ্গে বন্ধনও ছিন্ন হবে, “The last Jacket has no pocket.” মৃত্যু মানে কাঁকর, পাথর ও মাটির সমাধিতে মিশে যাওয়া নয়, হিসাবের খাতা নিয়ে মহাশক্তিমান প্রভুর সামনে উপস্থিত হওয়া।

নতুন বছরে (২০১৮) প্রত্যাশা থাকল, সততার শক্তিতে সমাজ জাগ্রত হোক, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত এটিই সরলরেখার পথ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু স্লোগান নয়, প্রয়োজন পঙ্কিল পথ বর্জন এবং সততার অনুশীলন। পরিশুদ্ধ হোক বাবা-মা ও সন্তানের মনস্তাত্ত্বিকতা ও মনন। এ লেখা উৎসর্গিত হলো অসাধারণ সততায় স্বকীয় ও স্বতন্ত্র আমার বাবা-মায়ের জন্য।

লেখক : মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন
[email protected]

The post বাবা, আমি তোমাকে কারাগারে দেখতে চাই না appeared first on Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস.



This post first appeared on ChandpurTimes, please read the originial post: here

Share the post

বাবা, আমি তোমাকে কারাগারে দেখতে চাই না

×

Subscribe to Chandpurtimes

Get updates delivered right to your inbox!

Thank you for your subscription

×